জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দশ মাস পর গত ৩ জুন নগরীর রাধাকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা আমেনা বেগম বাদী হয়ে তার স্বামী ছমেছ উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হাজিরহাট থানায় ৫৪ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। এই মামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) নগরীর নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়ার একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেল গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেদিকে শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তারের বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে মামলাটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। মামলাটিকে মিথ্যা দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। তারা শিক্ষক মাহমুদুলের মুক্তি দাবি করেন। একই দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও।নিয়ে শুক্রবার বাদ জুম্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন তারা।
আরো পড়ুমামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কর্মসূচি বানচাল, প্রয়োজনে গুলি, বোমা, লাঠি, রামদা কিসিচ, লোহার রড, চাপাতি চাইনিজ কুড়াল ও দেশীয় মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হত্যা করে হলেও আন্দোলন প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশে রংপুরের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গসংগঠনের উল্লিখিত চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা গত বছরের ২ আগস্ট সন্ধ্যায় ৬টায় নিহত ছমেছ উদ্দিনকে বাড়ি সংলগ্ন মুদি দোকানের সামনে উপস্থিত হয়ে মামলার ৩ নম্বর আসামি দোকান থেকে নেমে হুমকি দেয় এবং ৪ নম্বর আসামি বলে ছমেছ পালাচ্ছে। এ সময় আসামির কথায় ছমেছ বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে বের হলে দেশি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে শরীরে বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর জখম করেন আসামিরা।২৯ থেকে ৫৪ নম্বর আসামি চারদিকে ঘিরে পুলিশকে ধরিয়ে দিলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে আসামিগণ ও পুলিশ পালিয়ে গেলে তাকে রংপুর প্রাইম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে রাত আটটার দিকে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এবং দুই নম্বর আসামি করা হয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে। এছাড়া তিন নম্বর থেকে ৫৩ নম্বর পর্যন্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা এই মামলার আসামি হলেও ৫৪ নম্বরে আসামি করা হয় মাহমুদুল হককে। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন ।
এদিকে, হাজিরহাট থানায় দায়ের করা আমেনা বেগমের এজাহারের সঙ্গে ছমেস উদ্দিনের কবরে টাঙানো সাইনবোর্ডের তথ্যে গরমিল দেখা গেছে। কবরে টানোনা সাইনবোর্ডে দেখা যায় ‘‘জাতীয় বীর ছমেছ উদ্দিন’, গত ২ আগস্ট ২০২৪ পুলিশের একটি দল তার বাড়িতে প্রবেশ করলে তিনি দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে যায়। পরে সেখানেই স্ট্রোক করে মারা যায় তিনি, যা নিশ্চিত করেন প্রাইম মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক।’ মূলত, ছমেছের কবরে সাইনবোর্ডে লেখা ঘটনার বর্ণনার সঙ্গে এজহারের বর্ণনার মিল না থাকায় এই বিতর্ক শুরু হয়।
চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে মামলার বাদী আমেনা বেগমের কাছ থেকেও। মামলার বিষয়ে গণমাধ্যমকে তিনি জানান, ‘মামলার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। শুধু সাক্ষর দিয়েছি। আসামি কে, কার বয়স কত, কিছু জানি না।’
তিনি আরো বলেন, ‘ঘটনার দিন বিকেলে তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন পুলিশ সদস্য পাশের এলাকায় যায়। তথ্য পেয়ে পুলিশ তার স্বামীর দোকানের সামনে আসেন। এরপর তিনি দোকান থেকে বেড়িয়ে পালাতে চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ তাকে ধাওয়া করে। কিছুদূর দৌড়ানোর পর তিনি হঠাৎ পড়ে যান। পরে পথচারীরা তাকে রাস্তার পাশে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে খবর দেন। খবর পেয়ে প্রতিবেশী মোশাররফ হোসেন সেখানে যান এবং ছমেছ উদ্দিনকে দ্রুত প্রাইম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণাবিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সামছুর রহমান সুমন লেখেন, ‘একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে এমন ধৃষ্টতা মোটেও কাম্য নয়। প্রাথমিক তদন্ত না করেই গ্রেপ্তার করা যা তাদের জন্য স্পষ্ট সম্মানহানিকর। যে বা যারাই এমন ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক।
শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তারের বিষয়ে হাজিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল আল মামুন শাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আসব। নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না।
তদন্ত ছাড়াই তাকে গ্রেপ্তার করার কারণ জানতে চাইলে ওসি বলেন, এ ঘটনার তদন্ত চলছে। করেন।’নন।

Post a Comment