চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় স্বার্থে ‘ঐক্যের’ ডাক দিয়েছেন। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবাইকে এক হওয়ার আহবান জানান তাঁরা। তবে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবি ঐক্যে বিভক্তি তৈরি করছে কি না—এ প্রশ্নও তোলেন তারেক রহমান।
গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপি আয়োজিত ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনাসভা এবং শহীদ পরিবারের সম্মানে বিশেষ অনুষ্ঠানে দলের দুই শীর্ষ নেতা জাতীয় ঐক্যের এই আহবান জানাএর মাধ্যমে চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তিতে ৩৬ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি শুরু করল বিএনপি। খালেদা জিয়া তাঁর গুলশানের বাসভবন থেকে এবং তারেক রহমান লন্ডন থেকে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের ওপর নির্মিত ‘জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবার, আহত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, বুদ্ধিজীবী, সিনিয়র সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেনশহীদ পরিবারকে অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট ও সম্মাননা দেওয়া হয়। গুম-খুন ও জুলাই-আগস্টে শহীদ পরিবারের সদস্যদের কয়েকজন বক্তব্য দেন।
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে : খালেদা জিয়া
প্রধান অতিথির বক্তব্যে খালেদা জিয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, তা আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে যেকোনো মূল্যে। বীরের এই রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা যাতে বৃথা না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্য বজায় রাখআসুন, আমরা সবাই মিলে শহীদ জিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করি। বাস্তবায়ন করি কোটি মানুষের নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন।’
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন, গ্রেপ্তার, হত্যা ও খুনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে, সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে বাংলাদেশকে গড়ার। এই আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের জানাচ্ছি আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং আহতদের সমবেদনা। তাঁদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরকাল মনে রাখবে। গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি পরিবারের সম্মানজনক পুনর্বাসন ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।আসুন, আমরা সবাই মিলে শহীদ জিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করি। বাস্তবায়ন করি কোটি মানুষের নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন।’
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন, গ্রেপ্তার, হত্যা ও খুনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে, সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে বাংলাদেশকে গড়ার। এই আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের জানাচ্ছি আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং আহতদের সমবেদনা। তাঁদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরকাল মনে রাখবে। গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি পরিবারের সম্মানজনক পুনর্বাসন ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।এই মুহূর্তে ঐক্য বেশি প্রয়োজন : তারেক রহমান
জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য জরুরি মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল চিন্তা-ভাবনা করে প্রস্তাব দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, দেশ ও জনগণের কল্যাণে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই উত্তম প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। প্রস্তাব ভালো হলেও সব প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী কি না, সেটি বিবেচনা করার জন্য আপনাদের বিনীত আহবান জানাব।’
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার দাবি তুলেছে। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে এই পদ্ধতির নির্বাচনের বিধান রয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এবং ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই মুহূর্তে এই ব্যবস্থা কতটুকু উপযোগী কিংবা উপযোগী কি না, তা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখার জন্য সবার কাছে অনুরোধ করছি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে হলে, বাংলাদেশকে তাঁবেদারমুক্ত রাখতে হলে এই মুহূর্তে জনগণের ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু পিআর পদ্ধতির নির্বাচনী ব্যবস্থা ঐক্যের বদলে বিভক্তিমূলক সমাজ ও অস্থিতিশীল সরকার সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠতে পারে কি না—এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখার জন্য আমি সব রাজনৈতিক নেতাদের বিনীত আহবান ও অনুরোধ কতিনি এও বলেন, ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার আড়ালে পুনরায় দেশের রাজনীতিতে নিজেদের অজান্তে পতিত পরাজিত ও পলাতক অপশক্তির পুনর্বাসনের পথ তৈরির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কি না—এই বিষয়টিও আমাদের প্রত্যেকের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা দরকার। আমি মনে করি নিত্যনতুন বিষয় যদি আমরা সামনে নিয়ে আসতে থাকি, এর সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ পাবে।’
তারেক রহমান বলেন, ‘একটি দুর্নীতিমুক্ত, নিরাপদ ও মানবিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সুমাহান লক্ষ্যে দেশের গণতন্ত্রকামী প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মসূচিগত পার্থক্যের কারণে কোনো কোনো ইস্যুতে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য মনে হলেও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জাতীয় স্বার্থে আমরা সবাই এক। হাজারো শহীদের রক্তস্নাত রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী এই ঐক্য গড়ে উঠেছে। ৫ আগস্ট এর জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রতিটি ইস্যুতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য হওয়া জরুরি নয়। তবে অবশ্যই জাতীয় ইস্যুতে ও জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য থাকাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। এটি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।’
তিনি বলেন, ‘আগামী দিনে আর কোনো অপশক্তি যেন তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার দুঃসাহস না দেখায়, সংবিধান লঙ্ঘনকারী পতিত, পরাজিত পলাতক তাঁবেদার অপশক্তি আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কেউ যাতে অপতৎপরতা চালাতে না পারে, আমি ও আমাদের দল বিএনপি বিশ্বাস করে, এসব বিষয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য অটুট রয়েছে, ভবিষ্যতেও তা অটুট থাকবে।’
তারেক রহমান বলেন, ‘বিএনপি দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিধি-ব্যবস্থাকে এমন একটি চিরস্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে রাজনৈতিক দল ও সরকারের সব রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক থাকবে জনগণ। জনগণই তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার—প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। জনগণের নির্বাচিত সরকার জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে নির্ধারিত মেয়াদের পর সেই সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতাও জনগণের হাতে থাকবে। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করে এভাবে জনপ্রতিনিধিদের জনগণের মুখাপেক্ষী করে দেওয়া গেলে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের প্রবণতা কমে আসবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সক্রিয় রয়েছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের পাশাপাশি বিতাড়িত ফ্যাসিস্টদের বিচার কার্যক্রমও শুরু করেছে। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে সংস্কার ও বিচার কার্যক্রম চলমান প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র ও সমাজে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিশ্চিত রাখার স্বার্থে ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক সরকারও অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সুতরাং একটি ইস্যুকে আরেকটি ইস্যুর সঙ্গে শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ না করা যৌক্তিক বলে জনগণ মকাঁদলেন তারেক রহমান
অনুষ্ঠানে গুমের শিকার ছাত্রদল নেতা পারভেজের কন্যা নিধির বক্তব্য শুনে কেঁদেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
নিধির রয়েছে ছোট্ট একটি ভাই। বাবাকে অনেক দিন দেখে না সে-ও। অনুষ্ঠানে নিধি বলে, ‘আমি আর আমার ভাই বাবাকে কি কোনো দিন জড়িয়ে ধরতে পারব না?’ এ সময় তারেক রহমান কয়েকবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। চোখের চশমা সরিয়ে তাঁকে অশ্রু মুছতে দেখা যায়।
গুম ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যারা গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের সবার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।নে করে।’রব।তে হবে।।ন।

Post a Comment