Top News

দরিয়া-ই-নূর হীরাসহ ১০৯ রত্নের মালিক কারা

 


১১৭ বছর ধরে ব্যাংকের ভল্টে পড়ে আছে দরিয়া-ই-নূর হীরাসহ ঢাকার নবাব পরিবারের ১০৯ রত্ন। সরকারি নথি বলছে, ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহর নেওয়া এক ঋণের বিপরীতে বন্ধকি হিসেবে সম্পদগুলো বর্তমানে রাখা আছে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে। ৮৭ বছর আগে ১৯৩৮ সালে সেই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষ হয়। তবে বন্ধকি সম্পত্তি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি ব্রিটিশ, পাকিস্তান, এমনকি বাংলাদেশ সরকার।


প্রথম আলোর অনুসন্ধানে পাওয়া ঢাকা নওয়াব এস্টেটের ১৯৩৭ সালের এক চিঠির তথ্য বলছে, সে বছর পর্যন্ত ঋণের বেশির ভাগ অংশ পরিশোধ করা হয়েছিল। তবে পরের বছর পর্যন্ত বকেয়া ঋণ কত ছিল, তার কোনো তথ্য ভূমি সংস্কার বোর্ডে নেবর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দরিয়া-ই-নূরসহ ১০৯ রত্নের প্যাকেট যাচাই-ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এসব সম্পদের মালিকানার প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে।


সরকারি নথি, পুরোনো চিঠিপত্র, নবাব পরিবারের দাবি ও গবেষকদের মতামত বিশ্লেষণে দেখা যায়, সব মিলিয়ে বিষয়টি জটিল হয়ে উঠেছে। ফলে সম্পদের মালিকানার বিতর্ক সহজে মিটছে না।


গবেষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সম্পদের স্বত্বের এই জট খুলতে দরকার স্বচ্ছ তদন্ত ও আইনি উদ্যোযে কারণে ব্যাংকের ভল্টে রত্ন


নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের একজন প্রভাবশালী ও দানশীল ব্যক্তি। জনকল্যাণমূলক কাজ, শিক্ষার বিস্তার ও মুসলিম রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বরাবরই ছিলেন অগ্রগামী। তবে এই কাজের পেছনে যেভাবে অর্থ ব্যয় হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে তাঁকে গভীর আর্থিক সংকটে ফেলে দেয়।


সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথি থেকে জানা যায়, ১৯০৭ সাল নাগাদ জনসেবা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নবাব সলিমুল্লাহর প্রায় ৩৭ লাখ রুপি ব্যয় হয়। এই বিপুল খরচ মেটাতে তিনি ব্যক্তিগত সঞ্চয় ও সম্পত্তির আয় থেকে ব্যয় করেন। এমনকি স্ত্রীদের গয়নাও তাঁকে বন্ধক রাখতে হয়। তারপরও আর্থিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।


শেষমেশ নওয়াব এস্টেটের জমি ও সম্পত্তি বন্ধক রেখে একজন মাড়োয়ারি ও একজন হিন্দু মহাজনের কাছ থেকে ১৪ লাখ রুপি ঋণ নেন নবাব সলিমুল্লাহ। তিনি এই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণদাতারা আদালতে মামলা করেন। মামলার রায় নবাবের বিপক্ষে যায়। এতে নবাব পরিবারের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।


নবাব সলিমুল্লাহর এমন সংকটময় মুহূর্তে এগিয়ে আসে ব্রিটিশ সরকার। ঋণদাতাদের সমুদয় পাওনা তারা পরিশোধ করে। আর্থিক বিপর্যয় এতটাই গভীর ছিল যে নবাব সলিমুল্লাহ নিজেই তাঁর জমিদারি পরিচালনায় ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন। ১৮৭৯ সালের কোর্ট অব ওয়ার্ডস (সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা আদালত) আইন অনুযায়ী, তিনি নিজেকে জমিদারি পরিচালনার জন্য অযোগ্য ঘোষণার আবেদন করেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পূর্ব বাংলা ও আসাম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নবাব সলিমুল্লাহকে জমিদারি পরিচালনার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে। একই সঙ্গে নওয়াব এস্টেটের সব সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়।


বিভিন্ন ঋণ পরিশোধের জন্য ১৯০৮ সালের ৬ আগস্ট নবাব সলিমুল্লাহ কোর্ট অব ওয়ার্ডসের কাছ থেকে ১৪ লাখ রুপি ঋণ গ্রহণ করেন। এ জন্য তিনি তাঁর সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নয়টি শর্তে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অনুকূলে বন্ধক রাখেন। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ছিল দরিয়া-ই-নূর হীরাসহ ১০৯ রত্ন। সেই থেকে ব্যাংকের ভল্টে আছে রত্নগুলো।


দেশভাগের আগে রত্নগুলো ছিল ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ভল্টে। পাকিস্তান আমলে ছিল স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ভল্টে। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তা সোনালী ব্যাংকের ভল্টেতথ্য নেই ভূমি সংস্কার বোর্ডে


দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোর্ট অব ওয়ার্ডসকে ভূমি সংস্কার বোর্ডের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথিপত্র থেকে জানা যায়, নবাব সলিমুল্লাহর নেওয়া ঋণ ছিল ৩০ বছর মেয়াদি। অর্থাৎ ১৯৩৮ সালের মধ্যে তা পরিশোধ করার কথা ছিল।


কোর্ট অব ওয়ার্ডস ও ভূমি সংস্কার বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছে, এই ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধ করা হয়নি। তবে ঋণ কতটা পরিশোধ করা হয়েছিল, বকেয়া ঋণ কত ছিল, সে বিষয়ে কোনো তথ্য তাঁরা দিতে পারেননি।


২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল নবাব সলিমুল্লাহর বকেয়া ঋণের বিষয়ে জানতে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিল স্যার সলিমুল্লাহ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংগঠন। সে সময় ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ঋণ সর্বসাকল্যে সুদসহ পরিশোধিত হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ কোর্ট অব ওয়ার্ডস অফিসেঋণ কি পরিশোধ হয়েছিল


নবাব সলিমুল্লাহর নেওয়া ঋণ পরিশোধ করা হয়েছিল কি না, তা জানতে অনুসন্ধান করে প্রথম আলো। অনুসন্ধানে ১৯৩৬ ও ১৯৩৭ সালের ঢাকা নওয়াব এস্টেটের দুটি চিঠি পাওয়া যায়।


চিঠি দুটির লেখক ঢাকা নওয়াব এস্টেটের তৎকালীন প্রধান ব্যবস্থাপক মৌলভি এম ইয়াহিয়া। দুটি চিঠিতেই নবাব সলিমুল্লাহর নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ ২৫ হাজার রুপি উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ঋণের পরিমাণটি সুদসহ কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।


১৯৩৬ সালের ১০ অক্টোবর প্রথম চিঠিটি নবাব পরিবারের একজন উত্তরসূরিকে উদ্দেশ করে লেখা। চিঠিতে মৌলভি ইয়াহিয়া লিখেছেন, ‘প্রিয় নবাবজাদা, আপনার ৯ তারিখের চিঠি পেয়েছি। ভারত সরকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুরের নামে দেওয়া ১৬ লাখ ২৫ হাজার রুপির ঋণ আগাম পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে। তাই এই ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনাদের মধ্যে অতিরিক্ত অর্থ বা লভ্যাংশ বণ্টন করতে পারছি না।’


দ্বিতীয় চিঠিটি লেখা হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ২৩ মার্চ তারিখে, নবাব সলিমুল্লাহর পুত্র আহসানুল্লাহকে উদ্দেশ করে। চিঠিতে মৌলভি ইয়াহিয়া লেখেন, নবাব সলিমুল্লাহর নেওয়া ১৬ লাখ ২৫ হাজার রুপির ঋণের বিপরীতে ৩ লাখ ৮৪ হাজার রুপি বকেয়া রয়েছে।


১০৯ রত্নের মালিক কারা


ভূমি সংস্কার বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৯০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা নওয়াব এস্টেটকে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীন নেওয়া হয়। ১৯৫০ সালে ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট (জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন)-এর আওতায় এই এস্টেট বাতিল করা হয়। তবে আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ, আশপাশের জমি এবং যেসব জায়গায় সাধারণ মানুষ বসবাস করত বা জমি চাষ করত, সেগুলো সরকারের অধিগ্রহণের বাইরে থেকে যায়। সেই সঙ্গে তখনকার অনেক পারিবারিক দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি না হওয়ায় নওয়াব এস্টেটের কিছু সম্পত্তি এখনো ভূমি সংস্কার বোর্ডের তত্ত্বাবধানে আছে।


জমি তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কোর্ট অব ওয়ার্ডসের হাতে থাকলেও নবাব সলিমুল্লাহর বন্ধকি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতা আজও কাটেনি। ফলে ৮৭ বছর ধরে দেনার দায় রয়ে গেছে নবাব সলিমুল্লাহর, যিনি ১৯১৫ সালে মারা যান।


নবাব সলিমুল্লাহর প্রপৌত্র খাজা নাইম মুরাদ (চিত্রনায়ক নাইম) প্রথম আলোকে বলেন, দরিয়া-ই-নূরসহ ১০৯ রত্নের মালিক নবাব পরিবারের বর্তমান উত্তরসূরিরা। সরকারের কাছে বারবার তাগাদা দিয়েও নবাবের বকেয়া ঋণের কোনো তথ্য তাঁরা পাননি। অথচ বছরের পর বছর ধরে বলা হয়ে আসছে, নবাব সলিমুল্লাহ ঋণগ্রস্ত।


নাইম মুরাদ বলেন, ‘নবাব সলিমুল্লাহর ঋণ থেকে থাকলে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে আমরা তা পরিশোধ করতে চাই। সরকার ও নবাব পরিবারের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করে ঋণসংক্রান্ত সব তথ্য উন্মোচন করতে হবে। ঋণসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে আমাদের সম্পদ ও রত্ন ফিরিয়ে দিতে হবে।’


ভূমি সংস্কার বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নবাব পরিবারের ৬০০ একরের বেশি সম্পত্তি দেখভাল করছে কোর্ট অব ওয়ার্ডস। এসব সম্পত্তি থেকে বছরে গড়ে দেড় কোটি টাকা আয় হয়। এর মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয় নবাব পরিবারের উত্তরসূরিদের।


নবাব পরিবারের আরেক সদস্য কে এম হারিস আদিল বলেন, বিভিন্ন সময়ে সরকার আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ, দিলকুশা এলাকাসহ নবাব পরিবারের বেশ কিছু সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে। এর টাকাও নবাব পরিবারের সদস্যরা পেয়েছিলেন। ঋণ বকেয়া থাকলে তা এসব টাকা থেকে কেন পরিশোধ করা হয়নি, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।


কোর্ট অব ওয়ার্ডস ঢাকা নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজার মোহাম্মদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নবাব সলিমুল্লাহর ঋণ ৩০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল। এই ঋণ সুদাসলে শোধ হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই। তাই তাঁর সম্পত্তির মালিক সরকার।


নবাব সলিমুল্লাহর সম্পদের মালিকানার বিষয়ে একই কথানবাব পরিবারের চিঠি


দরিয়া-ই-নূরসহ ১০৯ রত্ন যাচাই-ব্যবস্থাপনার জন্য গত ২৬ মে একটি কমিটি গঠন করেছে সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়। কমিটির সদস্যসচিব ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো কমিটির কোনো সভা হয়নি।


এমনকি রত্নবিশেষজ্ঞ হিসেবে কমিটিতে কাকে রাখা হবে, সে বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান এ জে এম সালাহউদ্দিন নাগরী ১৩ জুলাই প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘শিগগিরই আমরা সভা করব। এটা পাঁচ-দশ দিনের মধ্যে হতে পারে।’ বলছে ভূমি সংস্কার বোর্ডও। নেই। রাখা হয়।গ।ই।

Countdown Timer

Post a Comment

Previous Post Next Post