এক ফোঁটা রক্তের অভাবের কারণে বহু মানুষ প্রাণ হারান। দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার বা দুর্লভ রোগের চিকিৎসায় রক্তের প্রয়োজন অমূল্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এবার সেই হাহাকার অতীত হতে চলেছে। জাপানের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন বেগুনি রঙের এক কৃত্রিম রক্ত বা পার্পল ব্লাড। এটি "ইউনিভার্সাল আর্টিফিশিয়াল ব্লাড" হিসেবেও কাজ করবে। অর্থাৎ কোনও নির্দিষ্ট গ্রুপ নেই এই রক্তে, ফলে যেকোনো ব্যক্তিকেই এই রক্ত দেওয়া যাবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই ‘পার্পল ব্লাড’ হলো হিমোগ্লোবিন ভেসিকেল (HbVs)। লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে থাকা হিমোগ্লোবিনই সারা শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করে। জাপানের তৈরি কৃত্রিম রক্তও হিমোগ্লোবিন-ভিত্তিক হওয়ায়, প্রাকৃতিক রক্তের মতোই এটি শরীরের সমস্ত অংশে অক্সিজেন বহন করতে পারে, অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে।পার্পল ব্লাডে একটি লিপিড মেমব্রেনের মধ্যে ন্যানো-আকারের হিমোগ্লোবিন কণা আবদ্ধ থাকে। ২৫০ ন্যানোমিটার (১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ) আকারের এই হিমোগ্লোবিন কণাগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃত্রিম লোহিত রক্তকণিকার মতো আচরণ করে। নারা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিরোমি সাকাই এবং তাঁর গবেষকদল এই কৃত্রিম রক্ত তৈরি করেছেন বিশেষ এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রথমে মেয়াদ ফুরনো রক্ত থেকে লোহিত রক্তকণিকা বের করে তা জীবাণুমুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর বিশেষ পদ্ধতিতে ভাইরাসমুক্ত এবং সংরক্ষিত সেলে কৃত্রিম উপায়ে এই লোহিত কণিকাগুলির পুনঃউৎপাদন ঘটানো হয়। এই কৃত্রিম রক্তে নেই কোনও নির্দিষ্ট গ্রুপ — অর্থাৎ A, B, AB বা O – কিছুই না। তাই এটি যেকোনো রোগীর শরীরে দেওয়া সম্ভব। সাধারণ রক্ত সর্বোচ্চ ৪২ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
তারপরে সেটি নষ্ট হয়ে যায় বা অকার্যকর হয়। কিন্তু এই নতুন কৃত্রিম রক্ত ২ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে, তাও স্বাভাবিক তাপমাত্রায়! এছাড়াও, সাধারণ রক্ত দেওয়ার আগে গ্রুপ মিলিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কখনও গ্রুপ না মেলায় বা সময়মতো রক্ত না পাওয়ায় রোগীর প্রাণসংশয় হয়। কিন্তু ইউনিভার্সাল ব্লাড ব্যবহার করলে এমন ঝুঁকি থাকবে না। তাই যুদ্ধক্ষেত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা এলাকাগুলিতে এই রক্ত হতে পারে জীবনদায়ী সমাধান। বেগুনি রঙই পার্পল ব্লাডকে লাল রঙের আসল রক্তের থেকে পৃথক করেছে। এই কৃত্রিম রক্তের বেগুনি রঙের কারণ হলো, এগুলি ব্যবহার না করা পর্যন্ত অক্সিডাইজ় করা যায় না। এই কৃত্রিম রক্ত সম্পূর্ণ ভাইরাসমুক্ত। আসল রক্তে দাতার শরীর থেকে গ্রহীতার শরীরে ভাইরাস ঢুকে যেতে পারে। কাজেই পার্পল ব্লাড ব্যবহার করলে HIV বা হেপাটাইটিসের মতো সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-এর তথ্য অনুযায়ী, গোটা বিশ্বে প্রতি বছর ১১ কোটি ২০ লক্ষ ইউনিট রক্ত দান করা হয়। তারপরেও সরবরাহের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি থাকে। সর্বজনীন ভাবে দেওয়া যায় এবং বড় আকারে উৎপাদন করা যায় বলে পার্পল ব্লাডের মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণের বড় সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে ব্লাড ব্যাঙ্কের উপরে নির্ভরতাও কমবে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে, ১৬ জন সুস্থ স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে এই কৃত্রিম রক্ত প্রয়োগ করা হয়েছে। তাদের শরীরে ১০০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার রক্ত দেওয়া হয়। বর্তমানে তারা বিশেষজ্ঞদের কড়া নজরদারিতে রয়েছেন। প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী কোনও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ধরা পড়েনি। যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয়, তাহলে ২০৩০ সাল থেকে জাপান হবে প্রথম দেশ, যেখানে কৃত্রিম রক্ত ব্যবহার করে রোগীর চিকিৎসা শুরু হবে। এটি হবে বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।
সূত্র : নিউজ ১৮
Post a Comment