মুকেশ আম্বানির ছেলের বিয়েই কি সর্বনাশ করল ভারতের

 

ভারতের গুজরাট রাজ্যের বৃহৎ শহর জামনগর। কচ্ছ উপসাগরের তটে রৌদ্রোজ্জ্বল শহরটি মূলত একটি শিল্পাঞ্চল। শহরটি গত বছর অনেক মার্কিন নাগরিকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। আর এর কারণ ছিল হলিউডের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী রিয়ানা।


জামনগরে ২০২৪ সালের মার্চে এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানির প্রাক্‌–বিবাহ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন রিয়ানা। দর্শকসারিতে ছিলেন বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, ইভাঙ্কা ট্রাম্পসহ নামীদামি অনেক অতিথি।


নামজাদা এসব অতিথি জামনগরে ছিলেন, যেখানে নেই কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কিংবা বেশির ভাগ অতিথির থাকার উপযোগী হোটেল। কারণ, শহরটির বন্দর ও তেল শোধনাগার আম্বানি সাম্রাজ্য এবং তাঁর ১১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের সম্পদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েচলতি সপ্তাহে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে এই জামনগর। এর কারণ, শহরের জ্বালানি তেলশিল্প। এসব জ্বালানি তেলের একটি অংশ আসে রাশিয়া থেকে। আর বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


মাসের পর মাস ধরে ওয়াশিংটন আর নয়াদিল্লির মধ্যে চলা বাণিজ্যিক আলোচনা গত জুলাইয়ের শেষ দিকে ভেঙে পড়ে। দেশ দুটির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেও ফাটল ধরে। গত ৩০ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটাক্ষ করে লেখেন, মার্কিন কোম্পানিগুলো হয়তো শিগগিরই ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে তেল খনন শুরু করবে। ‘কে জানে, হয়তো একদিন তারা ভারতের কাছেই তেল বিক্রি করবে!’


এর ঠিক এক সপ্তাহ পর, ট্রাম্প আরও কড়া একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত ভারতের রপ্তানিকারকদের জন্য বিপদের দুয়ার খুলে দেন। ট্রাম্প অভিযোগ করেন, ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেল বাণিজ্য থেকে মুনাফা তুলে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে দেশটির সরকার। এর মধ্য দিয়ে দেশটি ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টা সহায়তা করছে।


ট্রাম্প কোনো কোম্পানির নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু ঘুরেফিরে সব সূত্র মুকেশ আম্বানি এবং তাঁর কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে মিলে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটের জামনগরে কোম্পানিটির প্রধান তেল শোধনাগার অবস্থিত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শোধনাগার। জামনগর ও পুরো ভারতে রিলায়েন্স গ্রুপের বিনিয়োগ পরিকল্পনা হয়েছে মোদি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদদের পরাজামনগরে প্রতিদিন ১৫ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রক্রিয়াজাত করে রিলায়েন্সের শোধনাগার। এর এক-তৃতীয়াংশই আসে রাশিয়া থেকে।


রিলায়েন্স নামটি আজ ভারতের প্রতিটি প্রান্তে পরিচিত। মুকেশ আম্বানির বাবা ১৯৬৫ সালে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে পলিয়েস্টার ব্যবসা দিয়ে এই কোম্পানির যাত্রা শুরু করেছিলেন। কোম্পানিটি এখন ভারতের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী। জ্বালানি, তথ্য ও মোবাইল নেটওয়ার্ক, খুচরা ব্যবসা, আর্থিক খাতসহ নানা ক্ষেত্রে প্রভাবশালী অবস্থান রয়েছে তাদের। তারা এইচবিওর স্ট্রিমিং সেবা চালায়, বিশ্বের অন্যতম দামি ক্রিকেট দলের মালিক, বহু দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করে এবং সম্প্রতি ভারতের প্রায় সব শীর্ষ ফ্যাশন ব্র্যান্ড কিনে নিয়েছে।


রিলায়েন্সের এক মুখপাত্র বলেন, জামনগরে রিলায়েন্স শোধনাগার উন্নত প্রযুক্তির দিক থেকে আন্তর্জাতিকভাবে শীর্ষ পর্যায়ের। বিভিন্ন ধরনের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা রয়েছে এখানে। এই শোধনাগারে পারস্য উপসাগর, লাতিন আমেরিকা বা যেখানে ভালো দামে পাওয়া যায়, সেখান থেকে তেল এনে দ্রুত প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব। গত ২৫ বছরে জামনগর শোধনাগারে ৫০০ ধরনের অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াজাত হয়েছে।


জামনগরের অন্য বড় শোধনাগারটি হলো নায়ারা এনার্জির, যা রিলায়েন্সের চেয়ে ছোট হলেও আধুনিক ও শক্তিশালী। ২০১৭ সাল থেকে এর ৪৯ শতাংশ মালিক রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি রসনেফট। অর্থাৎ রাশিয়া নিজেই তেল পাঠাচ্ছে, ভারতে তা প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে আর কিছু ক্ষেত্রে ইউরোপেও আবার রপ্তানি রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এই দুই শোধনাগারই সমুদ্রপথে রুশ তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয়। ইউরোপের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাশিয়া বাধ্য হয়েছিল যেকোনো ক্রেতার কাছে ছাড়ে তেল বিক্রি করতে। এ ক্ষেত্রে ভারত, চীন ও তুরস্ক এগিয়ে আসে।


প্রথম দুই-তিন বছর এই বাণিজ্য কেউ খুব একটা আমলে নেয়নি। এমনকি ২০২৪ সালের মে মাসে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি প্রকাশ্যে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম কেউ রুশ তেল কিনুক, যাতে দামের স্থিতি থাকে।’


রিলায়েন্স যে পরিমাণ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে, তার প্রায় ৩০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। কোম্পানিটির এক মুখপাত্র বলেন, ‘শুধু রুশ জ্বালানি তেলে মূল্যছাড়ের কারণে লাভ হচ্ছে, এ কথা ভুল। রিলায়েন্স দশকের পর দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে লাভে আছে। যুদ্ধকালীন ছাড়ের আগে ও পরে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় বেশি মুনাফা রিলায়েন্সের। রিলায়েন্স ইউরোপে পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রি করে যে আয় করে, তা মোট উৎপাদনের খুবই সামান্য অংশ।


জামনগরের আরেকটি বড় শোধনাগার হলো নায়ারা এনার্জি, যা রিলায়েন্সের শোধনাগার থেকে কয়েক মাইল দূরে। নায়ারার শোধনাগারও বড় ও আধুনিক। যদিও রিলায়েন্স যে পরিমাণ জ্বালানি তেল পরিশোধন করে, তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ করে নায়ারা। ২০১৭ সাল থেকে নায়ারার ৪৯ শতাংশ মালিকানা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি রসনেফটের। এর অন্যতম বড় অংশীদার একটি রুশ মালিকানাধীন বিনিয়োগ প্রতিরসনেফট–সমর্থিত একটি প্রতিষ্ঠান রাশিয়া থেকে তেল কিনে ভারতে প্রক্রিয়াজাত করছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তা আবার ইউরোপে বিক্রি করছে। রিলায়েন্সের মতো বৈচিত্র্যময় ব্যবসা না থাকায় নায়ারা মূলত এই এক খাতের ওপর নির্ভরশীল।


ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বছরেই ভারতের এই বেসরকারি শোধনাগারগুলো সমুদ্রপথে রুশ জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয়। ইউরোপে বাজার হারিয়ে ছাড়ে জ্বালানি তেল বিক্রি শুরু করে রাশিয়া। আর ভারত, চীন ও তুরস্ক এই ছাড়ের সুযোগ নেয়।


প্রথম দুই-তিন বছর ভারত ও মার্কিন সরকার বিষয়টিকে খুব একটা বড় সমস্যা হিসেবে নেয়নি এবং স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে। এমনকি ২০২৪ সালের মে মাসে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি ওয়াশিংটনে এক সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম কেউ রুশ জ্বালানি তেল কিনুক, যাতে দামের স্থিতি থাকে।’


তাই ট্রাম্পের এই আচমকা আঘাত অনেককেই অবাক করেছে। নয়াদিল্লির ন্যাটস্ট্রাট থিঙ্কট্যাঙ্কের প্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ সরন বলেন, ২০২২ সাল থেকেই প্রকাশ্যে রাশিয়া থেকে তেল কেনা হচ্ছে। অথচ এখন বিষয়টিকে শাস্তির কারণ বানানো হলো। তাঁর মতে, আসলে রুশ জ্বালানি তেল নিয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কথাবার্তা একপ্রকার ধোঁয়াশা তৈরি করার কৌশল।


ভারত, বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল বড় অর্থনীতি। জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। দেশটির নিজস্ব তেলের মজুত খুব কম। মোট চাহিদার ৮৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়। আগে এর বেশির ভাগ আসত পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে, যা দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ তৈরি করত। তাই সরকার শোধনাগার শিল্পকে সরাসরি উৎসাহ দিয়েছে।


তবে এখন ট্রাম্পের হুমকি মোদি সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। রাশিয়া থেকে দূরে সরে আসা মানে নতি স্বীকার করা, যা ভারতের কোনো নির্বাচিত নেতার পক্ষে সহজ সিদ্ধান্ত নয়।ষ্ঠান।হচ্ছে।মর্শে।ছে।

Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post