বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: প্রভুত্ব নয়, বন্ধুত্বই কাম্য
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী ভারতের সহযোগিতা, সমর্থনের কথা নিশ্চয় আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে জীবন রক্ষা করেছিল প্রতিবেশী বাঙালি অধ্যুষিত তিন রাজ্যের মানুষ। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা–এই রাজ্য তিনটি অবাঙালি অধ্যুষিত হলে পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে না-ও থাকতে পারত। জাতীয়তার টান যে কত গভীর, ওই সময়ে শরণার্থীমাত্রই সেটা বুঝতে পেরেছিল। নানা সীমাবদ্ধতার পরও আমাদের শরণার্থীদের আশ্রয়সহ সকল প্রকার সহযোগিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেছিল তিন রাজ্যের বাঙালিরা। অবাঙালিরা এমনটি যে করত না, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। এতে ভারত রাষ্ট্রের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক সুবিধার কথা বলা হয়। ভারত আমাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নেয়নি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাই দেশের অভ্যন্তরে এসে যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধ করেছিল। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান ভারত আক্রমণের পরই ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধে প্রত্যক্ষে জড়িয়ে পড়ে। তাই পাকিস্তান ভাঙার দায় পাকিস্তানিদেরই। পাকিস্তানি সামরিক সরকার আমাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে রাষ্ট্র ভাঙার পথ প্রসারিত করেছিল। ভারত তো আগ বাড়িয়ে পাকিস্তান ভাঙতে আসেনি। বিপরীতে পাকিস্তানিরাই রাষ্ট্র ভাঙার মূল কাজটি করেছিল। পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে আমাদের মুক্তির জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙা তো অপরিহার্য ছিল। ২৩ বছরের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অধীনে আমাদের থাকা সম্ভব নয়। জাতিগত বিদ্বেষ ধর্মীয় ঐক্যকে বিদ্বেষমুক্ত করেনি; বরং, জাতিগত ভিন্নতায় বিদ্বেষ-বৈষম্য ছিল সর্বাধিক।ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ফলেই আমাদের স্বাধীনতা লাভ দ্রুত সম্ভব হয়েছিল, এটা খুবই সত্য। তবে ভারতের প্রত্যক্ষ সামরিক সহযোগিতা ব্যতিরেকে বিলম্বে হলেও আমাদের স্বাধীনতা আমরা নিশ্চয় অর্জন করতাম, এটাও অসত্য নয়। ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা নিশ্চয় রয়েছে। তাই বলে আনুগত্য কিন্তু নেই। আমাদের বন্ধুত্ব দ্বিপক্ষীয় হবে–এটাই ছিল প্রত্যাশিত। বাস্তবে তেমনটি হয়েছিল, সেটা কিন্তু বলা যাবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একপক্ষীয় ছিল বললে ভুল হবে না।
বৃহৎ ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিগত সরকারের সাথেই ছিল সর্বাধিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। এ ছাড়া অন্যান্য প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক অম্ল-মধুর বলা যায়। বৃহৎ রাষ্ট্রের কর্তৃত্বপরায়ণতায় প্রতিবেশী দেশের সরকারগুলো নিশ্চুপ থাকলেও জনগণের মধ্যে অসন্তোষ কিন্তু বিরাজমান। আমাদের দেশবাসীর ক্ষেত্রেও সেটা দেখা গেছে। কারণগুলোও কিন্তু অমূলক নয়। ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলক চালুর অনুমতি নিয়ে বিগত অর্ধশতবর্ষব্যাপী ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনকে তোয়াক্কা না করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে আমাদের মরুদেশে পরিণত করেছে। তিস্তার পানি না-দিয়েও একই পন্থা অবলম্বন করেছে। কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবাঙালি বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার অভিযান চলেছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও রয়েছে একচ্ছত্র ভারতের রপ্তানির আধিপত্য। ভারতকে প্রতিদানহীন একতরফা করিডোর সুবিধা প্রদানে দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি হয়। প্রাপ্তিশূন্য করিডোর প্রদানে শেখ হাসিনা সরকারের নতজানু নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষে কোনো আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি। অথচ আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ সফরে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি তারা তা কোনোদিন ভুলতে পারবে না। তবে বাংলাদেশ বিনিময় চায় না। আমরা দিতেই ভালোবাসি, পেতে নয়।’ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থরক্ষা করেই সকল রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরূপ একতরফা নজির বোধ করি পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা প্রয়াত এইচ টি ইমাম ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আলোচনা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, ‘ভারতের মন ভোলানোর হাজার চেষ্টা চালালেও বিএনপি নেতারা সফল হবে না।’ তিস্তা চুক্তি না-হবার বিষয়ে বলেছিলেন, ‘অধরা তিস্তা চুক্তি নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলবেই। কিন্তু তিস্তা এখন আর মোটেও কোনো সমস্যা নয়। আজ হোক কাল হোক তিস্তা চুক্তি সই হবেই। দুই প্রতিবেশীর কারও কাছেই এটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না।’ তিস্তাকে সমস্যা না বলা এবং চুক্তি না হওয়া আমাদের প্রতি ভারতের অবিচার বললে নিশ্চয় অন্যায় হবে না। ভারতের সাথে বহু অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান না করে আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতকে দিতেই ভালোবাসেন, পেতে নয়।
আমাদের ভূখণ্ডে প্রতিটি রাজনৈতিক বাঁকে বিপদগ্রস্ত এবং আক্রান্ত হয়ে এসেছে দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। যার সূচনা ঘটেছিল ১৯৪৭-এর দেশভাগে। এরপর ১৯৫০-এর দাঙ্গা, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যায় হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে আক্রান্তের শিকার হয়েছিল বাঙালি জাতি। তুলনামূলকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। পাকিস্তান থেকে আগত সেনা-সদস্যদের হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তেমন বার্তাই তাদের দেওয়া হয়েছিল। হত্যাকারীরা তাই হিন্দুদেরকেই হত্যার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে। তবে গণহত্যাকালে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বাছ-বিচার হত্যাকারী সেনাবাহিনী করেনি। আত্মরক্ষায় প্রতিবেশী ভারতের এক কোটি শরণার্থীর বেশির ভাগই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। সাতচল্লিশ থেকে দেশত্যাগের ধারাবাহিকতায় তারা পলায়নপরতায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল যে, পরিস্থিতি আঁচ করে দ্রুত দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫-এর মধ্য আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে, বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে সৃষ্ট দাঙ্গায়, ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদলে এবং এবারের ২০২৪-এর ৫ আগস্ট ক্ষমতা পরিবর্তনের পর একই কায়দার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর মানবতাবিরোধী হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুদের হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, ছিল অতীতের ন্যায় তাদের সম্পত্তি, অর্থকড়ি লুণ্ঠনের অভিপ্রায়টি। এবং মূলে ছিল ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা।
এবারের হিন্দুদের সমাবেশ থেকে একটি স্লোগান তারা তুলেছে। যেটা কারও কারও কাছে আপত্তিকর বলে বিবেচিত হয়েছে। সেটা হচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’। ইতিপূর্বে আমাদের দেশে এ ধরনের স্লোগান হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দেয়নি। এই স্লোগান হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের স্লোগান। সারা ভারতে কেবল হিন্দু জাতীয়তাবাদী আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানটি দিয়ে থাকে। এ ছাড়া ভারতের অন্য কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি সাধারণ আম-জনতা এই স্লোগানটি দেয় না। স্লোগানটি অনিবার্যরূপে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক আরএসএস, বিজেপির স্লোগান। আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কেন এই স্লোগান দিচ্ছে? অনেকে ইতিমধ্যে এই স্লোগানের জন্য হিন্দুদের আরএসএস-ভুক্ত বলেও প্রশ্ন তুলেছে। অনতিবিলম্বে তাদের হিন্দুত্ববাদী এই স্লোগান পরিহার করতে হবে। নয়তো জনমনে ধারণা জন্মাবে, তারা হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করেছে।
Countdown Timer
00:01
Post a Comment