বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্বে ‘ছাত্রলীগ ক্যাডার’

 


এক সময়ের ছাত্রলীগ ক্যাডার ও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু পরিষদ নেতা এস এম আবু নাসের ফারুক এখন খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববদ্যালয়ের (খুমেবি) উপাচার্যের (ভিসি) দায়িত্বে। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ও খুমেবির বিদায়ি ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান মেয়াদ শেষের সাথে সাথেই নিয়মবহির্ভূতভাবে রেজিস্ট্রার এস এম আবু নাসের ফারুকের ওপর দায়িত্ব দেওয়ায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। 


এ ছাড়া আবু নাসের ফারুকের খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে চাকরিতে প্রবেশেও ছিল নানা অনিয়ম। এমনকি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা সনদে খুমেবিতে চাকরি হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠান তথা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে প্রবেশও নিয়মবহির্ভূত ও প্রশ্নবিদ্ধ ছিখুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকরি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি তড়িঘড়ি করে সেই চাকরি ছেড়ে খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। যা তখন ‘শেখ হাসিনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা’ নামে পরিচিত ছিল।


খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, সেখানকার ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেন আবু নাসের ফারুক। ২০১৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যোগ্যতা না থাকায় বিজ্ঞাপনের শর্ত লঙ্ঘন করে আবু নাসের ফারুককে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছেজানা যায়, খুবির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তে উল্লেখ ছিল, ‘ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের জন্য সহকারী রেজিস্ট্রার/সমমানের পদে চার বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ প্রথম শ্রেণির পদে সর্বমোট আট বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু আবু নাসের ফারুকের প্রথম শ্রেণির পদে আট বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলেও সহকারী রেজিস্ট্রার/সমমান পদে চার বছরের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। অর্থাৎ ফিডার পদের শর্ত পূরণের অভিজ্ঞতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিজ্ঞাপনের শর্ত লঙ্ঘন করে ছাত্রলীগের পরিচয়ে তিনি নিয়োগ পান।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি ঢাকার মাতুয়াইলের শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে কর্মরত ছিলেন।


যেটি নবম গ্রেডের একটি প্রথম শ্রেণির পদ। সেখানে তিনি সহকারী রেজিস্ট্রার বা সমমানের পদে ছিলেন না।

খুমেবির রেজিস্ট্রার নিয়োগের ক্ষেত্রে মাস্টার্স পর্যন্ত ১৭ বছরের একাডেমিক সময় এবং বয়স সর্বোচ্চ ৫০ বছর উল্লেখ থাকলেও আবু নাসের ফারুকের মাস্টার্স পর্যন্ত একাডেমিক সময় ১৬ বছর এবং বয়স ছিল ৫১ বছরের বেশি। সে কারণে খুমেবি এবং খুবি উভয় প্রতিষ্ঠানে তার নিয়োগ অবৈধ বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকরিকালীন গৃহীত বেতন ভাতা উত্তোলন এবং সেখান থেকে পেনশনপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেউভয় প্রতিষ্ঠানে তার নিয়োগের বিষয়টি তদন্তের দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট অভিযোগকারীরা।

এ ছাড়া আবু নাসের ফারুক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিকালীন সেখানে বঙ্গবন্ধু পরিষদের দায়িত্বশীল পদে ছিলেন বলেও জানা যায়। তিনি কৌশলে একটি এলপিসি আনেন, যেখানে ১৫ হাজার টাকা মূল বেতন দেখানো হয়। যা তার নবম গ্রেডের পরবর্তী ধাপ ইনক্রিমেন্ট ও টাইম স্কেল প্রাপ্তিতে আছে। অবশ্য তাতে নিয়োগ শর্ত পূরণ না হলেও আওয়ামী লীগ আমলে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় ছাত্রলীগ কোটায়।


এদিকে খুমেবির একটি সূত্র বলছে, রেজিস্ট্রার এস এম আবু নাসের ফারুক ভিসির দায়িত্ব পালন করলেও ভারপ্রাপ্ত ভিসি নন। অর্থাৎ তিনি শুধুমাত্র ভিসির রুটিন দায়িত্বগুলো পালন করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে নতুন ভিসি পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন, বোনাস, কেনাকাটাসহ অন্য সব আর্থিক লেনদেন বন্ধ থাকবে। কেননা ২০২১ সালের খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ভিসিই একাধারে একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট ও কেনাকাটা, পরিকল্পনা, উন্নয়ন (পূর্ত) কমিটির প্রধান। অর্থাৎ এসব দায়িত্ব কেবল পূর্ণাঙ্গ ভিসিরই। সে কারণে নতুন ভিসি না আসা পর্যন্ত যেমন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হবে না, তেমনি ঈদ বোনাসও বন্ধ থাকবে। 


বর্তমানে খুমেবিতে ৬ জন আউটসোর্সিং কর্মচারীসহ ৪৪ জন জনবল রয়েছে বলে জানিয়েছেন সহকারী রেজিস্ট্রার মোল্লা মো. নূরুল মোমেন। খুমেবির ট্রেজারার অধ্যাপক ডা. কামদা প্রসাদ সাহা বলেন, খুমেবির আইন অনুযায়ী ভিসির পর প্রো-ভিসি দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু প্রো-ভিসি নেই সেহেতু পরবর্তী দায়িত্ব কে পালন করবেন সেটি আইনে স্পষ্ট উল্লেখ নেই। তবে সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বলা আছে, প্রো-ভিসির পরবর্তী পদ ট্রেজারারের। এমতাবস্থায় রেজিস্ট্রারের ওপর ভিসির দায়িত্ব দিয়ে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের প্রশ্ন আমার জন্য বিব্রতকর।’


তবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে কোনো বিষয় স্পষ্ট না থাকে সে ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুাযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। খুমেবি ও সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে দায়িত্ব অর্পণ করা যেত। তাহলে আর কোনো প্রশ্ন থাকতো না। তা ছাড়া ট্রেজারার যেহেতু অর্থ কমিটিরও প্রধান সে কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ভিসি রুটিন দায়িত্ব পালন করতে গেলেও ট্রেজারারের অনুমোদন নিতে হবে। এছাড়া ভিসির দায়িত্বে অবশ্যই একজন চিকিৎসক হওয়ার বিষয়টি যেহেতু আইনে বলা আছে সে কারণে ভিসির রুটিন দায়িত্বও একজন চিকিৎসকের ওপর থাকা যৌক্তিক। এ ক্ষেত্রেও রেজিস্ট্রারের চেয়ে ট্রেজারার একধাপমেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ভিসির অবর্তমানে প্রোভিসি দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু প্রোভিসি না থাকলে রুটিন দায়িত্ব কে পালন করবেন সেটি আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিবের সাথে আলোচনা করি। তার পরামর্শ অনুযায়ী রেজিস্ট্রারের ওপর দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নিয়েছি।’


আওতাধীন ৯ মেডিক্যাল ও ৮ নার্সিং কলেজ


খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় বর্তমানে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও মাগুরা জেলার মোট ৯ টি সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ এবং খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও মাগুরার ৮ টি নার্সিং কলেজ রয়েছে। ওইসব মেডিক্যাল ও নার্সিং কলেজের পরীক্ষাসহ সকল কার্যক্রম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস কোর্সে চার হাজার ১৩৫জন এবং বিএসসি নার্সিংয়ের বেসিক ও পোস্ট বেসিক কোর্সে ২৪০০ শিক্ষার্থী রয়েস্থবিরতার আশঙ্কা 


বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, বর্তমানে জরুরি ভিত্তিতে ভিসি নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি প্রকল্প পরিচালক নিয়োগও জরুরি। তা না হলে খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম থমকে যাবে। 


জানা যায়, খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলাধীন তবে কেএমপির লবণ চরা থানার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৫০ একর জমিতে খুলনা শেখ হাসিনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। যেটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের জুন মাসে। পরে গত ১৩ এপ্রিল নাম পরিবর্তন করে করা হয় খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ভিসি ও পিডি নিয়োগ না হওয়ায় জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে অন্য কোনো কাজই করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ইতিমধ্যে ২০২৩ সালে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা কেডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জলমা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দু’বছরের জন্য এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নেওয়া হয়। অর্থাৎ চলতি বছরের(২০২৫) মধ্যে ভিসি ও পিডি নিয়োগের পাশাপাশি পরিকল্পনা কমিশন থেকে জিও করা না হলে আবারও পিছিয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ। বর্তমানে নগরীর নিরালা আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে খুমেবির অফিসিয়াল কার্যক্রম চলছে। যত দেরি হবে ততই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে বলেও আশংকা সংশ্লিষ্টদের।


বরাদ্দ সাড়ে ১২ কোটি টাকা


বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, বিগত চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ থেকে খুমেবিতে মোট ১২

কোটি ৫৭ লাখ ২১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় হয় যথাক্রমে এক কোটি ৩৪ লাখ এবং এক কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ওই টাকাও খুমেবি খরচ করে বলে বিদায়ী ভিসির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়।


যা বললেন আবু নাসের ফারুক


খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন দায়িত্ব পালনকারী এস এম আবু নাসের ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে ঈদের আগেই পূর্ণাঙ্গ ভিসি নিয়োগ হবে। তখন আর কোনো সংকট থাকবে না।’


খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু পরিষদের কোনো পদে ছিলেন না দাবি করে তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম। এমনকি খুবির সিন্ডিকেটেও ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর নিন্দা জানানো হয়।’ তখন তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ছিলেন।ছে। এগিয়ে।ছে।।ল।

Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post