Top News

উজাইর (আ.) ও একশ বছরের ঘুম

 


এক ধ্বংসস্তূপ শহর। বাতাসে এখনও পোড়া মাটির গন্ধ, পাথরভাঙা দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে কালো ঘাস গজিয়েছে। জনপদটা আর জনপদ নেই। কেবল নিস্তব্ধতা। ছিন্নপত্রের মতো ছড়িয়ে থাকা একজোড়া ধসে পড়া খড়ের চাল, দরজা নেই, জানালা নেই। যেন কেউ সময়কে দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বলে গেছে, আমি ছিলাম।সেই ধ্বংসের ভেতর দিয়ে হযরত উজাইর (আ.) একদিন হেঁটে যাচ্ছিল। সে এক ভ্রাম্যমাণ পথিক, নামহীন, গন্তব্যহীন, হাতে একটি ঝুলি, পায়ে ধূলি, সাথে একটি গাধা। ক্লান্ত গলায় ফিসফিস করে আপন মনে বলেছিল, খোদাবন্দ কিভাবে হাশরে আবার এই জনপদকে পুনর্জীবিত করবেন? তার কণ্ঠে কোনো অবিশ্বাস ছিল না, কিন্তু ছিল এক বিস্ময় আর ভাবনার ছায়া। 


 

প্রশ্নটা করেই সে একটা ছায়ামাখা গাছতলায় বসে পড়েছিল। স্রেফ বিশ্রামের জন্য, অথবা ভাবনার ভার রাখার মতো আর জায়গা ছিল না বলে। তার ঝুলির ভেতর রাখা ছিল সামান্য কিছু খাবার, শুকনো রুটি, শুকনো ফল আর কিছু পানি। আর গাধাটা বাঁধা ছিল নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরনো গুঁড়ি-গাছের সঙ্গে। তারপর সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যেমন মানুষ ক্লান্ত হলে ঘুমায়, অথবা কোনো অলৌকিক শান্তি যদি শরীরে নামে, তখন যেমন নিদ্রা গভীর হয়।

 

কিন্তু সে জানতো না, সেই ঘুম একশ বছরের। সময় তার শরীরের ওপর দিয়ে ঢেউয়ের মতো বয়ে গেছে। গাছটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, শহরের ধ্বংসস্তূপে এখন কেবল হাড়গোড় পড়ে আছে, ধুলোয় ঢাকা এক নীরব কঙ্কাল। আর তার পাশের গাধাটি এখন কেবল হাড়ের কাঠামো মাটির সাথে মিশে যাওয়া এক নির্বাক সাতারপর, হঠাৎ একদিন সে জেগে উঠলো। ঘুম ভাঙার পর চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো কিছু অদ্ভুত, অতিপ্রাকৃত কিছু ঘটে গেছে। শরীর যেমন ছিল, তেমনি। হাতের খাবার অক্ষত, পানীয়তে কোনো রঙের পরিবর্তন নেই। গাছতলার আলো এখন অন্যরকম। গাধাটার দিকে তাকিয়ে সে আঁতকে উঠলো। এ কেবল হাড়! কিন্তু হাড়গুলো যেন চোখের সামনে জোড়া লাগছে, শিরদাঁড়ার সাথে পাঁজর, তারপর পায়ের জোড়। একটি নতুন সৃষ্টি আবার গঠিত হচ্ছে। হাড়ের গায়ে মাংস চড়ে বসছে, আর চোখের পাপড়ির মতো ধীরে ধীরে প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে তার মধ্যে। গাধাটি চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।তখনই এক অদৃশ্য কণ্ঠ, অথচ চিরপরিচিত, জিজ্ঞাসা করলো, কত সময় তুমি এখানে ছিলে? সে বলল, একদিন, বা দিনের কিছু অংশ। কণ্ঠটি বললো, না, বরং তুমি ছিলে একশ বছর। তোমার খাবারের দিকে তাকাও তাতে কোনো পরিবর্তন নেই। আবার গাধার দিকে দেখো, কীভাবে আমি তার হাড়গুলো জোড়া দেই এবং তাতে প্রাণ ফিরিয়ে আনি। আমি তোমাকে নিদর্শন বানিয়েছি মানুষের জন্য।সে তখন বসে থাকে কিছুক্ষণ। নীরব, বিহ্বল। চোখের সামনে এক মৃত জনপদে আবার প্রাণের প্রতিচ্ছবি। সময়, মৃত্যু, সৃষ্টি সবকিছু যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। আর সে একজন মাত্র মানুষ যার প্রশ্ন একদিন তাকে এই পথ পর্যন্ত এনেছিল। এখন সেই প্রশ্নই তার জীবনের জবাব হয়ে উঠেছে। সে বলে উঠে, আমি জানি, নিশ্চয়ই খোদাবন্দ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

 

এই শহর আবার বাঁচবে। এই ধ্বংসের নিচে আবার কোনো কচুরিপানা জন্ম নেবে। কোনো শিশু স্যান্ডেল পায়ে ছুটবে ধুলো-ধোঁয়ার রাস্তায়। সময় একদিন থেমে গিয়েছিল বটে, কিন্তু জীবন থেমে যায় না। কারণ জীবন এক ফেরত আসা জিজ্ঞাসা, আর মৃত্যু একটি প্রমাণ মাত্র। দলিল (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৫৯):

 

অথবা তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখনি, যে একটি ধ্বংসস্তূপ শহরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল? সে বলল, আল্লাহ কীভাবে একে মৃত্যু‌র পর পুনর্জীবিত করবেন? তখন আল্লাহ তাকে একশ বছর মৃত অবস্থায় রাখলেন। তারপর তাঁকে পুনরুজ্জীবিত করলেন এবং বললেন, তুমি কত সময় অবস্থান করেছিলে? সে বলল, একদিন কিংবা দিনের কিছু অংশ। আল্লাহ বললেন, না, বরং তুমি একশ বছর অবস্থান করেছিলে। এখন তোমার খাবার ও পানীয়ের দিকে তাকাও, তা বিনষ্ট হয়নি। আবার তোমার গাধার দিকেও তাকাও, যেন আমি তোমাকে মানুষের জন্য নিদর্শন বানাতে পারি। এবার হাড়গুলোর দিকে তাকাও, আমি কীভাবে সেগুলো জোড়া লাগাই এবং তারপর মাংস পরাই। অতঃপর যখন সবকিছু তার কাছে স্পষ্ট হলো, তখন সে বলল, আমি জানি, নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

 

হযরত উজাইর (আ.)-এর এই অলৌকিক অভিজ্ঞতা কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি মানবজীবনের গভীরতম প্রশ্ন, মৃত্যুর পর পুনর্জীবনের সম্ভাবনা, তারই জীবন্ত জবাব। এক ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদ, একটি গাধা, কিছু খাবার এবং একশ বছরের ঘুম, এই সব উপকরণ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা এক মহান নিদর্শন সৃষ্টি করলেন। যেন মানুষ বুঝতে পারে, সময় আল্লাহর হাতে, মৃত্যু তার ইচ্ছায়, এবং পুনর্জীবন কোনো কল্পনা নয় বরং এক দিব্য বাস্তবতা। এই কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ধ্বংসের মাঝেও আছে সৃষ্টির সম্ভাবনা, নিস্তব্ধতার ভেতরেও লুকিয়ে থাকে জীবনের শব্দ। আল্লাহর কুদরতের সামনে সবকিছুই সম্ভব, এবং মানুষ—যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন—তাকে স্মরণ করেই পথ পায় চূড়ান্ত সত্যের দিকে।

~ সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৫৯ক্ষী।

Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post