মানুষের শরীরের একটি বড় অংশই পানি দিয়ে গঠিত। প্রতিদিন শরীরের ভেতরে নানা প্রক্রিয়ায় প্রচুর পানি খরচ হয়। ঘুমের সময়ও শরীর কাজ করে, শ্বাসপ্রশ্বাস, ঘাম, রক্ত সঞ্চালন—সব কিছুর জন্য পানি ব্যয় হয়। তাই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর শরীর আসলে থাকে পানিশূন্য অবস্থায়। এই সময় খালি পেটে এক বা দুই গ্লাস পানি পান করলে শরীর এক ধরনের নতুন শক্তি পায়। অনেকেই সকালের শুরুটা চা বা কফি দিয়ে করতে পছন্দ করেন, কিন্তু খালি পেটে পানি যে কতটা উপকারী তা অনেকের অজানা। পানি আসলে এমন এক সহজলভ্য প্রাকৃতিক টনিক, যা শরীরকে ভেতর থেকে পরিষ্কার রাখে এবং সুস্থ থাকার প্রাকৃতিক উপায় তৈরি করে।খালি পেটে পানি খেলে প্রথমেই হজম প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। রাতভর খাবার হজম হয়ে পেট প্রায় খালি থাকে। এ সময় পানি পেটে গিয়ে হজমে সহায়তা করে, কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় এবং খাবার হজমের জন্য পেটকে প্রস্তুত করে। অনেকেরই সকালে পেট পরিষ্কার না হওয়ার সমস্যা থাকে, নিয়মিত খালি পেটে পানি খেলে সেই সমস্যা ধীরে ধীরে দূর হয়। শুধু তাই নয়, শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতে পানি অসাধারণ কাজ করে। সারাদিনে খাওয়াদাওয়ার ফলে শরীরে নানা ধরনের বর্জ্য জমে যায়। ঘুমের সময় সেগুলো জমাট বাঁধে, সকালে পানি পান করলে প্রস্রাবের মাধ্যমে সেই বর্জ্য দ্রুত বেরিয়ে যায়।আরেকটি বড় উপকারিতা হলো বিপাকক্রিয়া বা মেটাবলিজম বৃদ্ধি। খালি পেটে পানি খেলে শরীরের ভেতরের কোষগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে, ক্যালরি বার্ন করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন, তাদের জন্য সকালে পানি পান এক অসাধারণ অভ্যাস হতে পারে। এতে ক্ষুধা কিছুটা কমে যায় এবং অযথা বেশি খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে। একইসঙ্গে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়, শরীরের প্রতিটি অঙ্গে সঠিকভাবে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে।
সকালে পানি খাওয়ার আরেকটি প্রভাব দেখা যায় ত্বকে। পর্যাপ্ত পানি না পেলে ত্বক নিস্তেজ হয়ে পড়ে, রুক্ষ ও কান্তিহীন হয়ে যায়। খালি পেটে পানি খেলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়, ত্বকের কোষগুলো পর্যাপ্ত আর্দ্রতা পায়। ফলে ত্বক স্বাভাবিকভাবেই উজ্জ্বল ও সতেজ হয়ে ওঠে। অনেক সময় বাজারের দামি ক্রিম বা কসমেটিক্সেও যে কাজ হয় না, নিয়মিত পানি পান করলে সেই কাজ সহজেই হয়।
পানি শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্যও সমান জরুরি। বিশেষ করে কিডনি সুস্থ রাখতে খালি পেটে পানি পান অত্যন্ত উপকারী। কিডনির প্রধান কাজ হলো শরীর থেকে ক্ষতিকর উপাদান বের করে দেওয়া। পর্যাপ্ত পানি না পেলে কিডনির ওপর চাপ বেড়ে যায়, এমনকি পাথরও হতে পারে। সকালে খালি পেটে পানি পান করলে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ে এবং ক্ষতিকর উপাদান সহজে বের হয়ে যায়। এভাবে কিডনি অনেকটাই চাপমুক্ত থাকে। একইভাবে হার্টকেও সুস্থ রাখতে পানি গুরুত্বপূর্ণ। যথেষ্ট পানি রক্তকে পাতলা রাখে, ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকেরই সকালে মাথাব্যথা বা অবসাদ অনুভূত হয়। এর অন্যতম কারণ হলো ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা। রাতে পানি না খাওয়ার ফলে শরীর অনেকটা শুকিয়ে যায়। তাই ঘুম থেকে উঠেই পানি পান করলে সেই ঘাটতি পূরণ হয়, মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক হয়, মাথাব্যথা কমে যায় এবং মন সতেজ হয়। পানি একপ্রকার প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিঙ্কের মতো কাজ করে, যা শরীরকে পুরো দিনটি সক্রিয় রাখার প্রস্তুতি দেয়।
এছাড়া মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যও খালি পেটে পানি পানের সঙ্গে জড়িত। রাতে দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া সকালে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। পানি দিয়ে মুখ ধোয়া ও পানি পান করলে সেই জীবাণুর কার্যকারিতা কমে যায়। এতে দাঁত ও মাড়ি সুস্থ থাকে, মুখের দুর্গন্ধও কমে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পানি সহজলভ্য ও খরচবিহীন একটি স্বাস্থ্য টনিক। এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, কোনো অতিরিক্ত কষ্ট নেই। শুধু অভ্যাসের মাধ্যমেই এটি আমাদের জীবনকে বদলে দিতে পারে। দিনে একবার খালি পেটে পানি পান করার এই ছোট্ট নিয়ম দীর্ঘমেয়াদে অনেক বড় স্বাস্থ্য উপকার বয়ে আনে।
তাই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই দুই গ্লাস পানি পান করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রথমে হয়তো কষ্ট লাগতে পারে, কিন্তু ধীরে ধীরে শরীর এটির সঙ্গে মানিয়ে নেবে। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে দেখা যাবে দিনটি অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও সতেজভাবে শুরু হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, খালি পেটে পানি হলো সকালের সেরা স্বাস্থ্য টনিক, যা আমাদের শরীর ও মনের যত্ন নেয় সহজতম উপায়ে।
Post a Comment