আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সকালের নাস্তা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সারারাত উপবাসের পর সকালে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায় এই নাস্তা। কিন্তু অনেকেই তাড়াহুড়ো, ব্যস্ততা বা অজ্ঞানতাবশত সকালের নাস্তা বাদ দিয়ে থাকেন। কেউ ভাবেন এতে ওজন কমবে, আবার কেউ মনে করেন নাস্তা না খেলেও শরীর ঠিকই চলবে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব শরীরের জন্য মারাত্মক হতে পারে। নিয়মিত নাস্তা বাদ দিলে নানা রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।নাস্তা বাদ দেওয়ার প্রথম সমস্যা হলো শরীরে শক্তির ঘাটতি। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার পর যদি শরীর প্রয়োজনীয় ক্যালোরি না পায়, তাহলে ক্লান্তি, মাথা ঘোরা ও মনোযোগের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থী বা কর্মজীবীদের জন্য এটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। নাস্তা বাদ দিলে মস্তিষ্কে গ্লুকোজের সরবরাহ কমে যায়। ফলে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়, অফিসের কাজে গতি থাকে না এবং সারাদিন অস্বস্তি অনুভূত হয়।আরেকটি গুরুতর প্রভাব হলো পাচনতন্ত্রের ওপর। দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকার কারণে পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি হয়। এর ফলে গ্যাস্ট্রিক, অম্বল বা আলসারের ঝুঁকি বাড়ে। যারা আগে থেকেই হজমের সমস্যায় ভোগেন, তাদের জন্য নাস্তা বাদ দেওয়া আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। খালি পেটে অনেক সময় বমি বমি ভাব, বুক জ্বালাপোড়া এবং পেট ফাঁপার মতো সমস্যাও দেখা দেয়।
নিয়মিত সকালের নাস্তা বাদ দিলে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। খালি পেটে থাকার কারণে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনগুলোর কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। এর ফলে দুপুর বা রাতে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। অনেক সময় মানুষ তখন চর্বিযুক্ত বা ভাজা-পোড়া খাবার খেয়ে নেন। এতে ওজন বাড়তে থাকে এবং স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে। অতিরিক্ত ওজন থেকে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের মতো জটিল অসুখ দেখা দিতে পারে।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও নাস্তা বাদ দেওয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। খালি পেটে থাকার পর হঠাৎ বেশি খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত নাস্তা বাদ দেন তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় অনেক হৃদরোগের ক্ষেত্রেও নাস্তা বাদ দেওয়া একটি ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস। সকালে না খেলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ভালো কোলেস্টেরল কমে যায়। এতে ধীরে ধীরে রক্তনালী শক্ত হয়ে যায় এবং হৃদপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালনে বাধা সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নাস্তা বাদ দেওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, নাস্তা না খেলে মেজাজ খিটখিটে হয়, অযথা রাগ বেড়ে যায় এবং উদ্বেগের মাত্রা বাড়ে। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের জন্য সকালের নাস্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের শরীর ও মস্তিষ্ক তখনো বিকাশের মধ্যে থাকে। নাস্তা বাদ দিলে তাদের মানসিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
নারীদের ক্ষেত্রেও নাস্তা না খাওয়ার ক্ষতি প্রবলভাবে দেখা যায়। নিয়মিত খালি পেটে থাকার ফলে মাসিকের অনিয়ম, চুল পড়া, ত্বক খারাপ হওয়া এবং হরমোনজনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। গর্ভবতী নারীরা যদি নাস্তা বাদ দেন তবে তা ভ্রূণের স্বাভাবিক বিকাশেও প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়া সকালের নাস্তা বাদ দেওয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও দুর্বল করে। খালি পেটে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে শরীর প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ পায় না। এতে শরীর সহজেই সংক্রমণ বা রোগে আক্রান্ত হয়। নাস্তা বাদ দিলে রক্তশূন্যতার ঝুঁকি বেড়ে যায়, বিশেষ করে যাদের খাদ্যাভ্যাসে আয়রন ও প্রোটিন কমসুতরাং, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য সকালের নাস্তা অপরিহার্য। এটি শুধু শরীরে শক্তি জোগায় না, বরং দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগ থেকে রক্ষা করে। নাস্তা বাদ দেওয়ার অভ্যাস যত দ্রুত সম্ভব পরিবর্তন করা উচিত। সহজ, হালকা ও পুষ্টিকর খাবার দিয়ে প্রতিদিন সকালের নাস্তা করা স্বাস্থ্যকর জীবনের অন্যতম শর্ত। যারা ওজন কমানোর জন্য নাস্তা বাদ দেন তারা ভুল পথে হাঁটছেন, কারণ নিয়মিত নাস্তা খাওয়াই আসলে ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
সকালের নাস্তা বাদ দেওয়া মানে শরীরকে ধীরে ধীরে নানা রোগের দিকে ঠেলে দেওয়া। তাই ব্যস্ততা বা অলসতার অজুহাত না দেখিয়ে প্রতিদিন সকালে কিছুটা সময় বের করে নাস্তা করা উচিত। এটি শুধু শরীরের জন্য নয়, মন ও মস্তিষ্কের জন্যও অপরিসীম উপকারী
Post a Comment