প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করে ক্যানসার ডেকে আনছেন না তো?

 


প্লাস্টিক দূষণ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত সংকটগুলোর মধ্যে একটি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ (যেমন ফথালেট, বিসফেনল-এ) এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করে হৃদ্‌রোগ, ক্যানসার, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, বন্ধ্যাত্ব, স্নায়ুবিক সমস্যা এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশকে দূষিত করে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে এবং খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি সৃষ্টি করেছে।প্লাস্টিক আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেও এর অত্যধিক ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। বাকি প্লাস্টিক বর্জ্য নদী, সমুদ্র ও মাটিতে জমা হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা খাদ্য ও পানির মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের রাসায়নিক উপাদান ফথালেট এবং বিসফেনল-এ হৃদ্‌রোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস এবং হরমোনাল ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।প্লাস্টিক দূষণ পরিবেশের জন্য কেন ক্ষতিকরপ্লাস্টিক পচনশীল না হওয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্য মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। প্লাস্টিক খুব ধীরে ধীরে অবক্ষয়িত হয়। অনেক প্লাস্টিক সামগ্রী প্রাকৃতিকভাবে ধ্বংস হতে প্রায় ৪০০ থেকে ১০০০ বছর পর্যন্ত সময় নেয়। প্লাস্টিকের পণ্য এবং বর্জ্য পরিবেশে জমা হয়ে থাকে, যা মাটিতে এবং পানিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিক ভেঙে ছোট ছোট টুকরোতে পরিণত হয়, যা মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাস, পানি এবং খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে এবং জীবজগতের জন্য বিষাক্ত হয়ে উঠে।প্লাস্টিক দূষণের প্রধান উৎস


১. একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক: প্লাস্টিকের বোতল, শপিং ব্যাগ, স্ট্র, ফুড প্যাকেজিং এবং বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পাত্র একবার ব্যবহারের পরই বর্জ্যে পরিণত হয়। বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত প্লাস্টিকের প্রায় ৫০ শতাংশ একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়।


২. মাইক্রোপ্লাস্টিক: প্লাস্টিক ধীরে ধীরে ভেঙে ৫ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট কণায় পরিণত হয়, যাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে। এটি প্রসাধনী (স্ক্রাব, টুথপেস্ট), সিনথেটিক কাপড় এবং টায়ার ঘর্ষণ থেকে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।


৩. প্লাস্টিক পোড়ানো: অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে ডাইঅক্সিন, ফিউরান এবং অন্যান্য কার্সিনোজেনিক পদার্থ বাতাসে মিশে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে।


৪. কৃষি ও শিল্প বর্জ্য: কৃষিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক মোড়ক, কীটনাশকের প্যাকেট এবং মেডিকেল বর্জ্য (সিরিঞ্জ, গ্লাভস) সঠিকভাবে অপসারণ না করায় তা পরিবেশে মিশে২০২৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল বটল ওয়াটার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদিত বোতলজাত পানির মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ সরবরাহ করা হয় কাঁচের বোতলে। সে তুলনায় প্লাস্টিকের বোতলের পরিমাণ বিপুল। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই পাঁচ হাজার কোটি বোতলজাত পানি বিক্রি হয় প্রতি বছর। আর পানির সঙ্গে বিক্রি হওয়া প্লাস্টিকের বোতলের মাত্র ৯ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়। বাকি অংশ রূপান্তরিত হয় বর্জ্যে।


বর্তমানে পলিথিলিন টেরেফথালেট (পিইটি) থেকে তৈরি করা হয় প্লাস্টিক বোতল। আর উৎপন্ন বোতলগুলো শতভাগ পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব। এরমধ্যে পিইটিকে পুনঃ প্রক্রিয়াজাত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে। তাছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহ প্লাস্টিক বোতলেই বেশি বিশ্বস্ত, তাই বিশ্ববাজারে বাড়ছে বোতলজাত পানির ব্যবসা।


২০২৪ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করা হয় ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন থেকে ৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন। যার মধ্যে ২১ দশমিক ৪ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়। বাকি ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ প্লাস্টিক বোতল নদী, সমুদ্র এবং ডাম্পিং স্টেশনে জমা হয়।


এই প্লাস্টিক বোতল প্রায় ৪০০-১০০০ বছর পর্যন্ত পরিবেশে টিকে থাকে, যা পরবর্তীতে পরিবেশ ও আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক ও বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়ায়। ঢাকায় এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) ‘একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের পরিবেশগত প্রভাব : দূষণ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন দাবি করেছেন। গবেষণায় তারা দেখিয়েছেন, শহরে পানির বোতল এবং গ্রামে কোমল পানীয়ের বোতল বেশি ব্যবহৃত হয়। দেশের প্রায় ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ প্রতিনিয়ত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে শহরে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ গ্রামের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ প্লাস্টিক বোতলের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন। এদের মধ্যে শহরের ৫১ শতাংশ এবং ৪২ শতাংশ গ্রামের ভোক্তা এই প্লাস্টিক বোতল একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেয়। বাকিরা একাধিকবার ব্যবহারের পর তা ফেলেআরও দেখা গেছে, বর্জ্য সংগ্রহকারীদের মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে সচেতন। এই প্লাস্টিক বোতল থেকে নির্গত রাসায়নিক যেমন বিসফেনল-এ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এসব ব্যবহারের ফলে শরীরের হরমোন সিস্টেমে বিঘ্ন ঘটে ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে শুরু করে ক্যানসার মতো রোগ তৈরির সম্ভবনা সৃষ্টি করে। জরিপ ভিত্তিক পদ্ধতিতে করা গবেষণাটি দেশের আটটি বিভাগের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের ওপর পরিচালনা করা হয়। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ভোক্তা, খুচরা বিক্রেতা ও বর্জ্য সংগ্রহকারীদের রাখা হয়। গবেষণাটি পরামর্শ দেওয়া হয়, পানির জন্য প্লাস্টিকের বোতলের পরিবর্তে ব্যবহার করা উচিত কাচের বোতল। এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। দরকার জনসম্পৃক্ততা।


‘দি আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি’র একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্য ও নিত্য ব্যবহার্য অনেক সামগ্রীতেই মাইক্রোপ্লাস্টিক খুঁজে পাওয়া গেছে, যা প্রতিনিয়তই ঢুকছে শরীরে। এই ধরনের প্লাস্টিক ক্যানসার রোগের আশঙ্কা বহু গুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্লাস্টিকের দ্রব্য তৈরি করতে বিসফেনল-এ রাসায়নিকটি ব্যবহার করা হয়। এই রাসায়নিকটি খুব সহজে নষ্ট করা যায় না। তাই সেটি পরিবেশেই থেকে যায়। ক্ষুদ্র আকারে খাবারের সঙ্গে মিশে তা মানব শরীরে প্রবেশ করে এবং নানারকম রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ‘দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি’-র তথ্য বলছে, প্রায় ১৬ হাজার রাসায়নিক থাকে প্লাস্টিকে। যার মধ্যে পিএফএএস, প্যারাবেনস, অ্যারোমাটিক অ্যামাইনের মতো অন্তত ৪০০ ধরনের রাসায়নিক মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এসব রাসায়নিক প্রতিদিনের ব্যবহারের জিনিসপত্র থেকেই শরীরে ঢুকছে। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, বাজারে যে চিনি এবং লবণ বিক্রি হচ্ছে তাতেও মিশে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। শুধু খোলা বাজারে নয়, অনলাইনেও যে লবণ এবং চিনি পাওয়া যায় সেগুলিতেও প্লাস্টিকের অস্তিত্ব রয়েছে। আবার বাড়িতে অফিসে, স্কুলকলেজ ও কাজের জায়গায় বেশিরভাগ মানুষই প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করেন। প্লাস্টিকের বোতলভর্তি পানিতে প্লাস্টিকের কণা মিশে থাকে, এমন তথ্য আগেই দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।


সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের থেকেও সূক্ষ্ম ন্যানো প্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে বোতলের পানিতে। এদের দৈর্ঘ্য ১ থেকে ৫০০০ মাইক্রোমিটারের মতো, যা মানুষের মাথার চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম। প্লাস্টিকের বোতলের পানিতে এই সূক্ষ্ম প্লাস্টিকের কণাগুলিই মিশে থাকে। প্লাস্টিকের বোতল থেকে পানি খেলে সেই প্লাস্টিকের কণাগুলি শরীরে ঢুকে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। ক্ষতিকর সেই সব উপাদান মানুষের শরীরের জন্য বিষ। বাড়িতেও খাবার খাওয়ার জন্যও অনেকে প্লাস্টিকের প্লেট, চামচ ইত্যাদি ব্যবহার করেন। প্লাস্টিকের কাপে চা বা কফি খাওয়া হয়। এই সব থেকেও প্লাস্টিকের কণা শরীরে ঢোকে, যা ক্যানসার ও হৃদরোগের অন্যতম কারণ বলেই মনে করছেন গবেষকেরা।


লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিচালক, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, চট্টগ্রাম দেয়। যাচ্ছে।

Countdown Timer

Post a Comment

Previous Post Next Post