ঘুম মানুষের শরীর ও মনের জন্য অত্যন্ত জরুরি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। দিনের পর দিন কাজ, পড়াশোনা বা নানা ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় ঘুম পূর্ণ হয় না। আবার অনেকেই ইচ্ছা করেও ঘুমাতে পারেন না। এই ঘুমের ঘাটতি শরীরে নানাভাবে ক্ষতি করে। সাধারণভাবে আমরা ভাবি ঘুম না হলে শুধু ক্লান্তি আসে বা মন খারাপ হয়, কিন্তু আসলে এর প্রভাব আরও গভীরে গিয়ে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মানসিক সুস্থতার ওপর পড়ে।
ঘুমের ঘাটতি হলে প্রথমেই মাথার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। মনোযোগ কমে যায়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল হয়, অল্পতেই রাগ ওঠে এবং অস্থিরতা দেখা দেয়। মস্তিষ্ক যেহেতু বিশ্রাম পায় না, তাই নতুন তথ্য মনে রাখা বা শিখতে সমস্যা হয়। যারা নিয়মিত ঘুম কম করেন তাদের স্মৃতিশক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমের ঘাটতি থাকলে উদ্বেগ, হতাশা এমনকি ডিপ্রেশন পর্যন্ত হতে পারে।শরীরের ভেতরের নানা জৈব প্রক্রিয়া সঠিকভাবে চলতে ঘুম অপরিহার্য। রাতে ঘুমের সময় শরীর কোষগুলো মেরামত করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সহজেই নানা সংক্রমণ, সর্দি-কাশি বা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। একজন মানুষ যদি কয়েকদিন ঘুম কম করেন, তবে তার শরীর রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে সাড়া দিতে পারে না।
ঘুম কম হলে হৃদযন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ঘুমের অভাব রক্তচাপ বাড়ায়। রক্তচাপ বেড়ে গেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়। হৃদপিণ্ডের সঠিক ছন্দ বজায় রাখতে এবং রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে ঘুমের ভূমিকা বিশাল। তাই রাত জেগে কাজ করা বা টানা ঘুম কমানো হৃদযন্ত্রের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে।
হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায়ও ঘুম অত্যন্ত জরুরি। ঘুমের ঘাটতি হলে শরীরে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনগুলো অস্বাভাবিকভাবে কাজ করে। ফলে অকারণে বেশি খিদে লাগে এবং অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এর কারণে স্থূলতা বা ওজন বেড়ে যাওয়ার সমস্যা তৈরি হয়। পাশাপাশি শরীরে শর্করা বিপাকের প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। দীর্ঘদিন ঘুম কম হলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাশরীরের সৌন্দর্য ও ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতাও ঘুমের ওপর নির্ভরশীল। রাতে ঘুম না হলে সকালে চোখের নিচে কালো দাগ হয়, মুখ ক্লান্ত দেখায় এবং ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়। নিয়মিত ঘুম কম হলে অকাল বার্ধক্যের লক্ষণ দ্রুত ধরা দেয়। তাই অনেকেই ঘুমকে প্রাকৃতিক বিউটি থেরাপি বলে থাকেন।
শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য ঘুম আরও জরুরি। এই সময় শরীর ও মস্তিষ্ক দ্রুত বেড়ে ওঠে। ঘুমের সময় গ্রোথ হরমোন নির্গত হয় যা তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদি এই সময় তারা যথেষ্ট ঘুম না পায়, তবে শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে এবং মানসিক বিকাশেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়, ঘুমের অভাব সমাজ ও কর্মক্ষেত্রেও বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। ক্লান্ত ও অমনোযোগী মানুষ সহজেই দুর্ঘটনার শিকার হয়। অনেক সময় ঘুমের ঘাটতির কারণে গাড়ি চালাতে গিয়ে ঘুমে ঢলে পড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। অফিস বা কর্মক্ষেত্রেও ভুল করার প্রবণতা বাড়ে। ফলে ব্যক্তিগত কর্মক্ষমতা কমে যায় এবং সামগ্রিকভাবে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
ঘুম শরীরের জন্য অক্সিজেন ও খাদ্যের মতোই অপরিহার্য। প্রতিদিন সাত থেকে আট ঘণ্টা গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম শরীরকে নতুন শক্তি দেয় এবং মানসিকভাবে সতেজ রাখে। ঘুমের ঘাটতি সাময়িকভাবে ক্ষতি করলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, মানসিক অসুস্থতা, এমনকি অকালমৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই ব্যস্ত জীবনের মাঝেও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা জরুরি। ঘুমকে অবহেলা না করে এটিকে সুস্থ জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে মানতে হবে।ড়ে।
Post a Comment