মানুষের জীবনে রোগ-ব্যাধি নতুন কিছু নয়। শরীরের ছোটখাটো অসুস্থতা থেকে শুরু করে দীর্ঘস্থায়ী জটিল রোগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনতে ওষুধের বিকল্প নেই। চিকিৎসকরা রোগীর উপসর্গ দেখে, শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে সঠিক ওষুধ নির্ধারণ করেন। কিন্তু আমাদের সমাজে একটি প্রবণতা দেখা যায়, সামান্য মাথাব্যথা, সর্দি-কাশি, জ্বর কিংবা গ্যাস্ট্রিক হলে মানুষ নিজে থেকেই ওষুধ খেতে শুরু করে। আবার অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন একই ওষুধ সেবন করে যায়। এভাবে অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস কেবল সাময়িক স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে শরীরের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো, বিশেষ করে কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিডনি আমাদের শরীরের একটি নীরব পরিশ্রমী অঙ্গ, যেটি দিনরাত রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ ছেঁকে বের করে দেয়। অথচ এই অঙ্গটির ক্ষতি ধীরে ধীরে হলেও একসময় তা জীবন সংকট তৈরি করে।অতিরিক্ত ওষুধ খেলে কিডনির ক্ষতি হওয়ার প্রধান কারণ হলো কিডনির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হওয়া। আমাদের শরীরে প্রতিদিন যত ধরনের খাবার, পানি বা ওষুধ যায়, সবকিছুর রাসায়নিক ভাঙন থেকে যে উপজাত পদার্থ তৈরি হয়, সেগুলো ছেঁকে শরীরের বাইরে বের করে দেওয়ার কাজ করে কিডনি। স্বাভাবিকভাবে কিডনি এই কাজ দক্ষতার সঙ্গেই করে। কিন্তু যখন শরীরে অতিরিক্ত ওষুধ ঢোকে, তখন সেগুলোর ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান রক্তে মিশে যায়। কিডনিকে তখন স্বাভাবিক কাজের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এই অতিরিক্ত চাপ দীর্ঘদিন চলতে থাকলে কিডনির ছাঁকন যন্ত্র, যাকে নেফ্রন বলা হয়, তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।বিশেষ করে ব্যথানাশক ওষুধ বা পেইনকিলার অতিরিক্ত খেলে কিডনির ক্ষতি দ্রুত হয়। অনেকেই সামান্য মাথাব্যথা বা শরীর ব্যথা হলেই নিয়মিত পেইনকিলার খেয়ে ফেলেন। এই ধরনের ওষুধ রক্তনালীর ভেতর রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয়। কিডনির ভেতরে পর্যাপ্ত রক্ত না পৌঁছালে নেফ্রনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ধীরে ধীরে কিডনি দুর্বল হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ক্রনিক কিডনি ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অ্যান্টিবায়োটিকও কিডনির ওপর প্রভাব ফেলে। আমরা জানি, অ্যান্টিবায়োটিক সংক্রমণ দূর করার জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অযথা বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেলে কিডনিকে সেগুলো ছেঁকে ফেলতে প্রচুর কষ্ট হয়। অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিকের রাসায়নিক কণাগুলো কিডনির ভেতরে জমে থাকে এবং সেগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিউব বন্ধ করে দেয়। এর ফলে মূত্রপ্রবাহে সমস্যা হয় এবং কিডনি ধীরে ধীরে বিষাক্ত পদার্থে ভরে যায়।
কিছু ওষুধ সরাসরি কিডনির টিস্যুতে ক্ষতি করে। যেমন কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, এমনকি কিছু হারবাল বা ভেষজ ওষুধও কিডনির ক্ষতি করতে পারে। অনেক সময় মানুষ ভাবে ভেষজ বা প্রাকৃতিক ওষুধ ক্ষতিকর নয়, কিন্তু সেগুলোতেও এমন কিছু উপাদান থাকতে পারে যা কিডনির জন্য বিষের মতো কাজ অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার কারণে কিডনির ভেতরে এক ধরনের প্রদাহও তৈরি হতে পারে। একে বলা হয় “ড্রাগ-ইনডিউসড নেফ্রাইটিস”। এতে কিডনির টিস্যু ফুলে যায়, রক্ত পরিশোধনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। প্রথমদিকে তেমন উপসর্গ বোঝা না গেলেও ধীরে ধীরে প্রস্রাবে ফেনা, শরীর ফুলে যাওয়া, ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অতিরিক্ত ওষুধ খেলে শরীরে ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য নষ্ট হয়। কিডনির কাজই হলো সোডিয়াম, পটাশিয়ামসহ বিভিন্ন খনিজের ভারসাম্য বজায় রাখা। কিন্তু ওষুধের অতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান কিডনির এই ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষমতাকে বিঘ্নিত করে। ফলে হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত স্পন্দন, উচ্চ রক্তচাপ এমনকি স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে।
সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, কিডনি ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে তা ধরা পড়ে না। মানুষ তখনও স্বাভাবিক জীবনযাপন করে, ভেবে নেয় সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু একসময় যখন কিডনি ৬০-৭০ শতাংশ কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন উপসর্গগুলো প্রকটভাবে ধরা দেয়। তখন চিকিৎসা অনেক কঠিন হয়ে যায় এবং ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো জটিল চিকিৎসা ছাড়া পথ থাকে না। অথচ এর পেছনে দায়ী থাকে বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কিডনির ক্ষতির ঝুঁকি যাদের আগে থেকেই বেশি, তাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ওষুধ আরও বিপজ্জনক। যেমন ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে ভোগা রোগীদের কিডনি আগে থেকেই দুর্বল থাকে। তারা যদি নিজের ইচ্ছায় ওষুধ খেতে শুরু করেন, তাহলে ক্ষতি কয়েকগুণ দ্রুএই কারণে সচেতন হওয়া জরুরি। ওষুধ মানেই নিরাপদ নয়। প্রতিটি ওষুধ শরীরে প্রবেশ করার পর একদিকে যেমন উপকার করে, অন্যদিকে তা শরীরের অন্য অঙ্গকে চাপের মধ্যে ফেলে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধই খাওয়া উচিত নয়। সামান্য মাথাব্যথা বা সর্দি-কাশির জন্যও অযথা পেইনকিলার বা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে কিডনির অবস্থা সম্পর্কে জানা যায় এবং প্রয়োজনে চিকিৎসক ওষুধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে দেন।
কিডনি আমাদের শরীরের এমন একটি অঙ্গ যা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সহজে আর আগের অবস্থায় ফেরানো যায় না। তাই অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার ঝুঁকি বুঝতে হবে। শরীরের ছোটখাটো অসুস্থতায় প্রাকৃতিক উপায় যেমন পর্যাপ্ত পানি পান, বিশ্রাম, সুষম খাদ্যগ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামান্য অসুবিধা দূর করার জন্য আজ যদি ওষুধের অপব্যবহার করি, কাল হয়তো তার জন্য আজীবন কিডনি বিকল হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। সচেতনতা আর সংযমই পারে এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে আমাদের রক্ষা করতে।ত হয়।করে।
Post a Comment