ওষুধের কার্যকারিতায় খাবারের ভূমিকা

 

ওষুধ একা কাজ করে না। কী ধরনের খাবার ও পানীয় রোগী গ্রহণ করছেন, সেটি সরাসরি এর কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে। তাই শুধু ওষুধ নয়, চিকিৎসার সহযাত্রী হিসেবে খাদ্যাভ্যাস নিয়েও সচেতন হতে হবে। খাবার ও ওষুধের পারস্পরিক ক্রিয়া কেমন হতে পারে, বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে সেটা তুলে ধরা যাক।ডায়াবেটিক রোগীদের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ওষুধ মেটফরমিন, যা দেহের স্বাভাবিক ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়। একজন ডায়াবেটিক রোগীর জীবনযাপন সম্পর্কে জানার পর চিকিৎসক এই ওষুধ দিয়েছিলেন। রোগী ভাবলেন, ওষুধ গ্রহণ করছি, তাই খাবার নিয়ে এত ভাবার দরকার নেই। তিনি ইচ্ছামতো শুরু করলেন চিনি আর মিষ্টি ফলের রস খাওয়া।চিকিৎসক ওষুধটি দিয়েছিলেন রোগীর স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে, বাড়তি চিনি গ্রহণ করবেন রোগী, সেটি আমলে নেওয়া হয়নি। ফলাফল, রোগীর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে ডায়াবেটিস আরো বেড়ে যায়।

এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ বাদ দেওয়ার পর মেটফরমিন ঠিকই কাজ করতে শুরু করে, ডায়াবেটিস চলে আসে নিয়ন্ত্রণে।


 


কেন হয়


ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে নানাভাবে। কিছু খাবার খেলে ওষুধ দেহে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয় বা দেহে ঠিকমতো ছড়িয়ে পড়তে পারে না। অ্যালকোহল গ্রহণ করলে বেশির ভাগ ওষুধ প্রস্রাবের পর দেহ থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়। স্থায়িত্ব কমে যাওয়ায় ওষুধ ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।


উল্টোটাও খাবার বা পানীয়র প্রভাবে ওষুধের কার্যকারিতা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে দেহের ক্ষতি করে। ওষুধের সঙ্গে সরাসরি বিক্রিয়া করে দেহে বিষক্রিয়াও সৃষ্টি করতে পারে কিছু খাবার। তাই ওষুধ ও খাবারের সম্পর্ক আমলে নেয়া জরুরি।

গবেষণা


খাবারের সঙ্গে ওষুধের বিক্রিয়া নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। অন্তত পাঁচটি খাবারের সঙ্গে কয়েকটি ওষুধের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কথা জানা গেছে। এর মধ্যে আছে—


গ্রেপফ্রুট জুস : ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলেছেন, অন্তত ৮৫টিরও বেশি ওষুধের কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে গ্রেপফ্রুট [সাইট্রাস গোত্রের একটি ফল] জুস। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওষুধগুলোর শোষণের মাত্রা এটি এতই বাড়িয়ে দেয় যে শরীরে তীব্র প্রভাব পড়ে এবং দেখা দেয় জটিল সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তাই যেকোনো ওষুধ গ্রহণ করার ক্ষেত্রেই গ্রেপফ্রুট পরিহার করা শ্রেউচ্চমাত্রায় চর্বি : চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের সঙ্গে কিছু ওষুধের শোষণ সরাসরি সম্পর্কিত। বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ গ্রিসেওফুলভিন শরীরে গ্রহণের হার দু-তিন গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় চর্বিযুক্ত খাবার খেলে। ক্লিনিক্যাল ফারমাকোকাইনেটিকসের ওপর ১৯৯৭ সালে চালানো এক গবেষণায় এটি জানা যায়।


ভিটামিন কে : অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট বা রক্ত পাতলা করার ওষুধের মধ্যে ওয়ারফারিন অন্যতম। এর কার্যকারিতা অনেকটাই নষ্ট করে ভিটামিন কে। পালং শাক বা ব্রকোলির মতো সবজি অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে এই ওষুধটির কার্যকারিতা নষ্ট হয় এবং উল্টো রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়েছে একাধিকবার।


লেবু : যাদের আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হয়, বিশেষ করে নন-হিম গোত্রের আয়রন, তাদের অবশ্যই খাবারে লেবু যোগ করতে হবে। নইলে শরীরে সাপ্লিমেন্ট ঠিকমতো শোষণ হয় না। এ বিষয়ে ১৯৮৯ সালে গবেষণা চালিয়েছিলেন হলবার্গ ও ব্রুন নামের দুই গবেঘুমের ওষুধ ও অ্যালকোহল : ডায়াজিপাম, সেটিরিজাইন বা এ ধরনের স্নায়ু-প্রশমনকারী ওষুধের সঙ্গে অ্যালকোহল গ্রহণ একেবারেই অনুচিত। ১৯৯৯ সালের এক গবেষণাপত্রে গবেষক ওয়েদারমন ও ক্র্যাব উল্লেখ করেন, অ্যালকোহল পান করার পাশাপাশি ঘুমের ওষুধ গ্রহণ করলে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়। 


 


প্রচলিত ওষুধ গ্রহণের নিয়ম


ওপরের পাঁচটি ছাড়াও আরো যেসব ফুড-ড্রাগ ইন্টার‌্যাকশনের কথা মনে রাখা উচিত—


►যন্ত্রণা নিবারক (এনালজেসিক) ঘরানার ওষুধ; যেমন—অ্যাসিটোঅ্যামিনোফেন গ্রহণ করলে অ্যালকোহল গ্রহণ বন্ধ রাখতে হবে। নইলে লিভার টক্সিসিটির আশঙ্কা আছে। অ্যালকোহল গ্রহণ কখনোই স্বাস্থ্যকর নয়, এটি সব সময়ই বর্জন করা উচিত।


►অ্যান্টিবায়োটিক ঘরানার ওষুধের শোষণের সঙ্গে খাবারের গভীর সম্পর্ক আছে। টেট্রাসাইক্লিন গ্রহণ করলে দুধ, দুগ্ধজাত খাবার এবং আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ বন্ধ রাখতে হবে। অথবা ওষুধটি গ্রহণের দুই ঘণ্টা আগে বা এক ঘণ্টা পরে এ ধরনের খাবার খেতে হবে। নইলে শরীরে ঠিকমতো শোষণ হবে না, অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা যাবে কমে। অ্যামোক্সিসিলিন, পেনিসিলিন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও অ্যারিথ্রোমাইসিন গ্রহণ করলে অবশ্যই খাবার গ্রহণের এক ঘণ্টা আগে বা দুই ঘণ্টা পরে ওষুধগুলো খেতে হবে। খালি পেটে না খেলে এই ওষুধগুলো ঠিকমতো শোষণ হয় না। নাইট্রোফুরানটোইন গোত্রের ওষুধের ক্ষেত্রে খাবারের পাশাপাশি গ্রহণে বাধা নেই, তবে কাজ করবে ধীরে। দ্রুত ফলাফল পেতে হলে এই ওষুধও খেতে হবে অ্যান্টিকোনভালেসেন্ট ওষুধ (খিঁচুনি দমনকারী); যেমন—বারবিট্রুয়েট বা প্রিমিডন গ্রহণ করলে অ্যালকোহল গ্রহণ বাদ দেওয়ার পাশাপাশি ভিটামিন সি গ্রহণও কমাতে হবে। নইলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাবে। 


►ক্যাফেইনের সঙ্গে থিওফাইলাইন বা ক্লোজাপাইন গ্রহণ করা যাবে না। হত্স্পন্দনের গতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেহ অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়বে।


 


মনে রাখা জরুরি


প্রায় সময়ই আমাদের দেশের রোগীরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওষুধ গ্রহণ করেন, যা একেবারেই অনুচিত। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণের নিয়মাবলি বা খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন না। ফলে ওষুধের সঙ্গে খাবারের প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে যাঁদের ক্রনিক অসুখ—ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হরমোনগত সমস্যা আছে, তাঁদের জন্য এ ধরনের বিক্রিয়া হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী।


►ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ ছাড়া খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা যাবে না। 


► ওষুধ গ্রহণের নিয়মাবলি অবশ্যই জেনে নিতে হবে। খাবারের আগে বা পরে, কোন খাবার খাওয়া যাবে না বর্জন করতে হবে।


► প্রতিটি ওষুধের সঙ্গে থাকা লেবেল বা লিফলেটে ফুড-ড্রাগ ইন্টার‌্যাকশন সম্পর্কে লেখা থাকে, পড়ে নেওয়া উচিত।


► বিশেষ ডায়েট বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে অবশ্যই তা চিকিৎসককে জানান।


 


লেখক : পুষ্টিবিদ, নিউট্রিশন অফিসার ন্যাশনাল হেলথ কেয়ার নেটওয়ার্কখালি পেটে।ষক।য়।হতে পারে।

Countdown Timer

Post a Comment

Previous Post Next Post