ইয়াজুজ-মাজুজের বিস্ময়কর কাহিনি

 

আল্লাহ তাআলা সুরা কাহাফে জুলকারনাইন বাদশাহ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইয়াজুজ-মাজুজের ব্যাপারে বলেছেন। সেখানে বলেছেন, কীভাবে মানুষকে তিনি ইয়াজুজ-মাজুজের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছেন।মদিনার ইহুদিরা মক্কার কোরাইশদের নবীজি (সা.)-এর কাছে কিছু প্রশ্ন করার পরামর্শ দিয়েছিল। প্রশ্নগুলো ছিল, আসহাবে কাহাফের ঘটনা, রুহের প্রকৃতি এবং জুলকারনাইনের ঘটনা। এই তিনটি বিষয়ে সুরা কাহাফে আলোচনা করা হয়েছে।


 

বাদশাহ জুলকারনাইন একজন নেক বান্দা ছিলেন। যাকে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে ভ্রমণের সুযোগ দান করেছিলেন। সারা বিশ্ব শাসন করতে যা করা লাগে তার সব উপকরণ তাকে দিয়েছেএকবার তিনি এক অঞ্চলে গেলেন, যেখানকার তার কথা বুঝতে পারছিল না। তারা তাকে জানাল, ইয়াজুজ-মাজুজের অত্যাচারে তারা অতিষ্ঠ। তখন তিনি তাদের সাহায্য করলেন। তাদের ঘটনা এভাবে উঠে এসেছে,“চলতে চলতে সে যখন পর্বত প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছল তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেল যারা তার কথা মোটেই বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, ‘হে জুলকারনাইন, ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে; আমরা কি আপনাকে রাজস্ব দিব এই শর্তে যে, আমাদের ও তাদের মধ্যে এক প্রাচীর গড়ে দিবেন?’

 

সে বলল, ‘আমার রব আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, সেটাই উত্তম। সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেব। তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও’। অবশেষে যখন সে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গা সমান করে দিল, তখন সে বলল, ‘তোমরা ফুঁক দিতে থাক’। এরপর যখন সে তা আগুনে পরিণত করল, তখন বলল, ‘তোমরা আমাকে কিছু তামা দাও, আমি তা এর উপর ঢেলে দেই’।

 

এরপর ইয়াজুজ ও মাজুজ তা অতিক্রম করতে পারল না বা ভেদ করতে পারল না।” (সুরা কাহাফ ৯৩-৯৭)

 

এভাবে বাদশাহ জুলকারনাইন ইয়াজুজ-মাজুজকে দুই পাহাড়ের মাঝে আটকে রাখেন।

 

ইয়াজুজ-মাজুজের পরিচয় কী?

 


ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে এতটুকু নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজুজ-মাজুজ মানব সম্প্রদায়ভুক্ত। অন্যান্য মানবের মত তারাও নুহ আলাইহিস সালামের সন্তান-সন্ততি। কোরআনুল কারিম স্পষ্টত বলেছে, وَجَعَلْنَا ذُرِّيَّتَهُ هُمُ الْبَاقِينَ (সুরা আস-সাফফাত ৭৭) অর্থাৎ হজরত নুহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনের পর দুনিয়াতে যত মানুষ আছে এবং থাকবে, তারা সবাই নুহ আলাইহিস সালামের সন্তান-সন্ততি হবে। ঐতিহাসিক বর্ণনা এ ব্যাপারে একমত যে, তারা ইয়াফেসের বংশধর।’ (মুসনাদে তাদের অবশিষ্ট অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক বিস্তারিত ও বিশুদ্ধ হাদিস হচ্ছে হজরত নাওয়াস ইবনে সামআন রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিসটি। সেখানে দাজ্জালের ঘটনা ও তার ধ্বংসের কথা বিস্তারিত বর্ণনার পর বলা হয়েছে,

 

এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করবেন, আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে এমন লোক বের করব, যাদের মোকাবেলা করার শক্তি কারো নেই। কাজেই (হে ঈসা,) আপনি মুসলিমদের সমবেত করে তুর পর্বতে চলে যান। (সে মতে তিনি তাই করবেন।) এরপর আল্লাহ তাআলা ইয়াজুজ-মাজুজের রাস্তা খুলে দেবেন। তাদের দ্রুত চলার কারণে মনে হবে যেন উপর থেকে পিছলে নিচে এসে পড়ছে। তাদের প্রথম দলটি তবরিয়া উপসাগরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তার পানি পান করে এমন অবস্থা করে দেবে যে, দ্বিতীয় দলটি এসে সেখানে কোনোদিন পানি ছিল, একথা বিশ্বাস করতে পারবে না।

 

হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গীরা তুর পর্বতে আশ্রয় নেবেন। অন্যান্য মুসলিমরা নিজ নিজ দুর্গে ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবে। পানাহারের বস্তুসামগ্রী সঙ্গে থাকবে, কিন্তু তাতে ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে একটি গরুর মস্তককে একশ দিনারের চাইতে উত্তম মনে করা হবে।

 

হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য মুসলিমরা কষ্ট লাঘবের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। (আল্লাহ দোয়া কবুল করবেন) তিনি মহামারি আকারে রোগব্যাধি পাঠাবেন। ফলে, অল্প সময়ের মধ্যেই ইয়াজুজ-মাজুজের গোষ্ঠী সবাই মরে যাবে।

 

এরপর হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম সঙ্গীদেরকে নিয়ে তুর পর্বত থেকে নিচে নেমে এসে দেখবেন পৃথিবীতে তাদের মৃতদেহ থেকে অর্ধহাত পরিমিত স্থানও খালি নেই এবং (মৃতদেহ পচে) অসহ্য দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। (এ অবস্থা দেখে পুনরায়) হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গীরা আল্লাহর দরবারে দোয়া করবেন। (যেন এই বিপদও দূর করে দেয়া হয়)। আল্লাহ তাআলা এ দোয়াও কবুল করবেন এবং বিরাটাকার পাখি প্রেরণ করবেন, যাদের ঘাড় হবে উটের ঘাড়ের মত। (তারা মৃতদেহগুলো উঠিয়ে যেখানে আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, সেখানে ফেলেকোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, মৃতদেহগুলো সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে। এরপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে। কোন নগর ও বন্দর এ বৃষ্টি থেকে বাদ থাকবে না। ফলে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ ধৌত হয়ে কাঁচের মত পরিস্কার হয়ে যাবে।

 

হজরত আব্দুর রহমান ইবনে ইয়ায়িদের বর্ণনায় ইয়াজুজ-মাজুজের কাহিনির আরও অধিক বিবরণ পাওয়া যায়। তাতে রয়েছে, তবরিয়া উপসাগর অতিক্রম করার পর ইয়াজুজ-মাজুজ বায়তুল মোকাদ্দাস সংলগ্ন পাহাড় জাবালুল-খমরে আরোহণ করে ঘোষণা করবে,

 

‘আমরা পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীকে হত্যা করেছি। এখন আকাশের অধিবাসীদের খতম করার পালা। সে মতে তারা আকাশের দিকে তীর নিক্ষেপ করবে। আল্লাহর আদেশে সে তীর রক্তরঞ্জিত হয়ে তাদের কাছে ফিরে আসবে। (যাতে বোকারা এই ভেবে আনন্দিত হবে যে, আকাশের অধিবাসীরাও শেষ হয়ে গেছে।) (মুসলিম ২৯৩৭)

 

অন্য হাদিসে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আদম আলাইহিস সালামকে বলবেন, ‘আপনি আপনার সন্তানদের মধ্য থেকে জাহান্নামীদেরকে তুলে আনুন। তিনি বলবেন, ‘হে আমার রব, তারা কারা? আল্লাহ বলবেন, প্রতি হাজারে নয়শত নিরানব্বই জন জাহান্নামি এবং মাত্র একজন জান্নাতি ৷ একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম শিউরে উঠলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের মধ্যে সে একজন জান্নাতি কে হবে? তিনি উত্তরে বললেন, চিন্তা করো না। তোমাদের মধ্য থেকে এক এবং ইয়াজুজ-মাজুজের মধ্য থেকে এক হাজারের হিসাবে হবে।’ (মুসলিরসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন যে, ‘ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাবের পরও বাইতুল্লাহর হজ ও ওমরাহ অব্যাহত থাকবে।’ (বুখারি ১৪৯০)। তাছাড়া রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন ঘুম থেকে এমন অবস্থায় জেগে উঠলেন যে, তার মুখমণ্ডল ছিল রক্তিমাভ হয়ে ছিল। তখন তিনি বলেন,

 

ইয়াজুজ-মাজুজ প্রত্যহ জুলকারনাইনের দেয়ালটি খুঁড়তে থাকে। খুঁড়তে খুঁড়তে তারা এ লৌহ-প্রাচীরের প্রান্ত সীমার এত কাছাকাছি পৌঁছে যায় যে, অপর পাশের আলো দেখা যেতে থাকে। কিন্তু তারা একথা বলে ফিরে যায় যে, বাকী অংশটুকু আগামীকাল খুঁড়ব। কিন্তু আল্লাহ তাআলা প্রাচীরটিকে আগের মতো মজবুত অবস্থায় ফিরিয়ে নেন। পরের দিন ইয়াজুজ-মাজুজ প্রাচীর খননে নতুনভাবে আত্মনিয়োগ করে। খননকার্যে আত্মনিয়োগ ও আল্লাহ তাআলা থেকে মেরামতের এ ধারা ততদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যতদিন ইয়াজুজ-মাজুজকে বন্ধ রাখা আল্লাহর ইচ্ছা রয়েছে। যেদিন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মুক্ত করার ইচ্ছা করবেন, সেদিন ওরা মেহনত শেষে বলবে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা আগামীকাল অবশিষ্ট অংশটুকু খুঁড়ে ওপারে চলে যাব। (আল্লাহর নাম ও তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করার কারণে সেদিন ওদের তাওফিক হয়ে যাবে।) পরের দিন তারা প্রাচীরের অবশিষ্ট অংশকে তেমনই অবস্থায় পাবে এবং তারা সেটুকু খুঁড়েই প্রাচীর ভেদ করে ফেলবে।’ (তিরমিজি ৩১৫৩, ইবনে মাজাহ ৪১৯৯, মুস্তাদরাকে হাকেম ৪/৪৮৮, মুসনাদে আহমাদ ২/৫১০, ৫১১)

 

আল্লামা ইবনে কাসির রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘হাদিসের উদ্দেশ্য এই যে, ইয়াজুজ-মাজুজের প্রাচীর খনন করার কাজটি তখন শুরু হবে, যখন তাদের আবির্ভাবের সময় নিকটবর্তী হবে। কোরআনে বলা হয়েছে যে, এই প্রাচীর ছিদ্র করা যাবে না। এটা তখনকার অবস্থা, যখন জুলকারনাইন প্রাচীরটি নির্মাণ করেছিলেন। কাজেই এতে কোনো বৈপরীত্য নেই। তাছাড়া কোরআনে তারা ছিদ্র পুরোপুরি করতে পারছে না বলা হয়েছে, যা হাদিসের ভাষ্যের বিপরীত নয়।ম ২২২) দেবে)।আহমাদ ৫/১১)ন।

Countdown Timer

Post a Comment

Previous Post Next Post