নিজেকে দিয়ে আল্লাহকে চেনার উপায়

 মহান আল্লাহর বিস্ময়কর এক সৃষ্টির নাম মানুষ। আল্লাহ মানবসৃষ্টির পরতে পরতে বিস্ময় রেখেছেন। মাতৃগর্ভে তার বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে তার শারীরিক গঠন, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, তার সামাজিক বিন্যাস ও জীবনধারা সবকিছুই যেন বিস্ময়ে ভরা।


সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ.) বলেন, ‘মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর এক বিরাট বিস্ময়কর সৃষ্টি। কিন্তু সে নিজের মূল্য এবং তার ভেতরে থাকা গোপন রহস্য সম্পর্কে উদাসীন। মানুষ যখন তা জানে, নিজের বিস্ময়কর ও রহস্যময় বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, তখন সে বিচলিত ও হতবাক হয়ে যায়।’ (ফি জিলালিল কোরআন, পৃষ্ঠা ৩৩৭৯)


নিজেকে ভেবে দেখার তাগিদ


পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ নিজেকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে উত্সাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন আছে ভূমণ্ডলে এবং তোমাদের মধ্যেও। তোমরা কি অনুধাবন করবে না?’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৩০-২১)


ইমাম তাবারি (রহ.) আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আয়াতে মানুষের মাটি থেকে সৃষ্টি, মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ, তার ইন্দ্রিয় শক্তি, তার বর্ণ-বৈচিত্র্য, ভাষার ভিন্নতা, অন্তরের উপলব্ধি, আকল বা বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা এসব বিষয় মহান স্রষ্টার একত্ববাদকে প্রমাণ করে। এটা প্রমাণ করে যে আর কোনো উপাস্য নেই এবং কেউ তার মতো সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। (তাফসিরে তাবারি)


যা নিয়ে এবং যেভাবে চিন্তা করব


মানুষ নিজেকে নিয়ে কিভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে তার কিছু দৃষ্টান্তও পবিত্র কোরআনে দেওয়া হয়েছে। যেমন—


১. নিজের সৃষ্টি নিয়ে : মহান আল্লাহ মানুষকে তার সৃষ্টি-প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তা-ভাবনার নির্দেশ দিয়ে বলছেন, ‘সুতরাং মানুষ চিন্তা করে দেখুক কী থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে। এটা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও পাজরের হাড়ের মধ্য থেকে।’ (সুরা তারিক, আয়াত : ৫-৭)


২. জন্মপ্রক্রিয়া নিয়ে : মাতৃগর্ভে আগমন, বেড়ে ওঠা ও জন্মগ্রহণের বর্ণনা কোরআনের একাধিক আয়াতে এসেছে। যেমন মানুষ এই বিস্ময়কর প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির উপাদান থেকে। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ আধারে। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি জমাট রক্তে, অতঃপর জমাট রক্তকে পরিণত করে মাংস পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থি-পাজরে; অতঃপর অস্তি-পাজরকে ঢেকে দেই গোশত দ্বারা। অবশেষে তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১২-১৪) 


৩. ইন্দ্রিয় শক্তি ও অবয়ব : আল্লাহ মানুষকে সর্বোত্তম অবয়ব এবং অনন্য ইন্দ্রিয় শক্তি দান করেছেন। যা অবশ্যই চিন্তা ও গবেষণা করা প্রয়োজন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করিনি দুই চোখ? আর জিহ্বা ও দুই ঠোক?’ (সুরা বালাদ, আয়াত : ৮-৯)


অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম অবয়বে।’ (সুরা তীন, আয়াত : ৪)


৪. মানবসমাজের বৈচিত্র্য নিয়ে : মানবসমাজে আল্লাহ যে বৈচিত্র্য দান করেছেন তাও নিয়েও গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন নারী ও পুরুষ থেকে এবং তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ে যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো।’ (অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে আছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে।’ (সুরা রোম, আয়াত : ২২)


৫. দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক বন্ধন নিয়ে : মানুষ নিজের দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক ব্যবস্থা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করবে। কেননা আল্লাহ যদি দাম্পত্য জীবন ও পরিবার দান না করতেন, তবে মানব শিশুরা পশু শাবকের মতো অযত্নে অবহেলায় মারা যেত। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে আছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের স্ত্রীদেরকে যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য আছে বহু নিদর্শন।’ (সুরা রোম, আয়াত : ২১)


৬. জীবন-জীবিকার শৃঙ্খলা : আল্লাহ মানুষের জীবন-জীবিকায় যে শৃঙ্খলা দান করেছেন তা অনন্য এক নিদর্শন। আল্লাহ বলেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে আছে রাত ও দিনে তোমাদের নিদ্রা ও তোমারে অন্বেষণ তার অনুগ্রহ থেকে। এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে শ্রবণকারী সম্প্রদায়ের জন্য।’ (সুরা রোম, আয়াত : ২৩)


৭. জীবনকাল ও জন্ম-মৃত্যু নিয়ে : মানুষ তার জীবনকাল এবং জীবনকালে তার ভেতর ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে। আল্লাহ বলেন, ‘তারপর তোমাদেরকে বের করেন শিশুরূপে, অতঃপর যেন তোমরা উপনীত হও তোমাদের যৌবনে, তারপর হয়ে যাও বৃদ্ধ। আর তোমাদের মধ্যে কারো মৃত্যু ঘটে এর আগেই! যাতে তোমরা নির্ধারিত কাল প্রাপ্ত হও এবং যেন তোমরা অনুধাবন করতে পার।’ (সুরা মুমিন, আয়াত : ৬৭)


নিজেকে দিয়ে আল্লানিজেকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সুফল হলো আল্লাহর পরিচয়, তার ক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত হওয়া। সুফি আলেমরা বলেন, আল্লাহকে চেনার একটি উপায় হলো নিজেকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। কেননা যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে সে জানতে পারে যে তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন কোনো একজন মহান স্রষ্টা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। তিনিই পৃথিবীর সবকিছু মানুষের অনুকূল করে দিয়েছেন। মহান স্রষ্টা যদি তার অনুগ্রহের ছায়া উঠিয়ে নেন, তবে মানুষের পক্ষে কিছুতেই জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়। এজন্য তারা বলে থাকেন, ‘যে নিজেকে চিনল সে তার প্রভুকে চিনল।’ (বাক্যটি হাদিস হিসেবে প্রচলিত হলেও এটা কোনো মনীষীর বাণী)


পবিত্র কোরআনেও এমন ইঙ্গিত মেলে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদের জন্য আমার নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করব, বিশ্ব জগতে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; ফলে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে এটাই সত্য। এটা কি তোমার প্রতিপালক সম্পর্কে যথেষ্ট নয় যে, তিনি সর্ববিষয়ে অবহিত?’ (সুরা হা-মিম-সাজদা, আয়াত : ৫৩)


আল্লাহ সবাইকে তার মহান সত্ত্বা ও গুণাবলী সম্পর্কে অবগত হওয়ার তাওফিক দিন। আমিনহকে চেনাসুরা হুজরাত, আয়াত : ১৩

Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post