বাংলাদেশে কিডনি রোগ এখন এক নীরব ঘাতক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ কিডনি বিকলের কারণে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো জটিল চিকিৎসার মুখোমুখি হচ্ছেন। অথচ এই রোগের একটি বড় অংশ প্রতিরোধযোগ্য—যদি আমরা খাদ্যাভ্যাসে সচেতনতা অবলম্বন করি।
মানবদেহে কিডনি মূলত রক্ত পরিশোধনের কাজ করে, শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। এটি আমাদের রক্তচাপ, হাড়ের স্বাস্থ্য, এমনকি রক্তে হিমোগ্লোবিন নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। ফলে কিডনির সামান্য সমস্যাও সারা শরীরে বড় ধরণের প্রভাব ফেলে।
খাবারের সঙ্গে কিডনি রোগের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। অতিরিক্ত লবণ টেস্টিং সল্ট, প্রোটিন, চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার নিয়মিত গ্রহণ করলে কিডনির ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। যেমন, অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপ তৈরি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনির ক্ষতি করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ৫ গ্রামের বেশি লবণ নেন, তাদের কিডনির গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট (GFR) দ্রুত কমে। অনিয়ন্ত্রিত প্রোটিন গ্রহণ — বিশেষত গরু ও খাসির মাংস বা প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট — কিডনিকে বাড়তি কাজ করায়। এতে Nephron নামক ফিল্টারিং ইউনিট নষ্ট হয়ে যায়।
ফাস্টফুড, চিপস, কোমল পানীয় ইত্যাদির মাধ্যমে অতিরিক্ত সোডিয়াম, ফসফরাস ও চিনির প্রবেশ ঘটে, যা শুধু কিডনিই নয় বরং হরমোন ও মেটাবলিজমেও সমস্যা তৈরি করে। বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে, এসব খাদ্যভ্যাস কিশোর ও তরুণদের মধ্যেও কিডনি সমস্যার সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে।
সঠিক খাওয়া-দাওয়া কিডনির জন্য এক ধরনের প্রতিষেধক। নিয়মিত পানি পান, প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণ, লবণ ও চিনি নিয়ন্ত্রণ, প্রোটিনের পরিমাণ বুঝে— খাওয়া এই সাধারণ বিষয়গুলোই কিডনি সুস্থ রাখার চাবিকাঠি।
বিশেষ করে, যারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ অথবা পারিবারিকভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত—তাদের জন্য খাদ্যভ্যাসে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। তাদের জন্য কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার, পর্যাপ্ত আঁশ, নিয়ন্ত্রিত প্রোটিন এবং নিয়মিত রেনাল চেকআপ অপরিহার্য।
এছাড়া, গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও কিডনি রোগ ঝুঁকিপূর্ণ। ফিল্ড গবেষণার ফলাফল বলে, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত প্রোটিন ও পানি গ্রহণ, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও নুন কমিয়ে খেলে প্রসব-পরবর্তী কিডনি জটিলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।
সচেতনতা ছড়াতে গেলে চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি খাদ্য সচেতনতাই হতে পারে প্রথম ও প্রধান ধাপ। তাই গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কিডনি-বান্ধব খাদ্যবিষয়ক বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে।
আজ যখন কিডনি রোগের জন্য হাসপাতালে জায়গা সংকট, চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে—তখন নিজের প্লেটকে সঠিকভাবে সাজিয়ে নেওয়াটাই হতে পারে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ।
লেখক: হাসিবুল হাসান
এম.এসসি (ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
ইন্টার্ন ডায়েটিশিয়ান, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
Post a Comment