ধূমপান মানুষের শরীরের জন্য একটি নীরব ঘাতক। এটি ধীরে ধীরে শরীরের ভেতর থেকে ক্ষয় ঘটায় এবং সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে ফুসফুসে। ফুসফুস আমাদের শরীরের অক্সিজেন গ্রহণ এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে দেওয়ার প্রধান অঙ্গ। প্রতিদিন আমরা যে বাতাস নেই, তা ফুসফুসের ভেতর দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে এবং শরীরকে শক্তি জোগায়। কিন্তু ধূমপানের ফলে এই প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে থাকা নিকোটিন, টার, কার্বন মনোক্সাইড এবং আরও অসংখ্য বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ফুসফুসের ভেতরে জমে থেকে কোষের ক্ষতি করে।প্রথমদিকে ধূমপানের প্রভাব বুঝতে না পারলেও সময়ের সাথে সাথে শ্বাস নিতে কষ্ট হতে শুরু করে। কারণ ধোঁয়ার টক্সিন ফুসফুসের ভেতরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বায়ুনালী ও বায়ুথলিকে দুর্বল করে দেয়। ফুসফুসের ভেতরে থাকা এই বায়ুথলিগুলো অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের আদান-প্রদান করে। যখন এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। এর ফলে মানুষ হাঁটাহাঁটি বা সামান্য কাজ করলেও হাঁপিয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধূমপান করলে ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি হয় এবং এই ক্ষতি আর কখনোই পূরণ হয় না।ধূমপানের কারণে সবচেয়ে পরিচিত রোগ হলো ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস ও এমফাইসেমা। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসে ফুসফুসের বায়ুনালীতে বারবার প্রদাহ হয় এবং অতিরিক্ত কফ জমে। ফলে রোগী সবসময় কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভোগে। অন্যদিকে এমফাইসেমা রোগে ফুসফুসের বায়ুথলি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ফুসফুসের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়। তখন রোগী ঠিকমতো শ্বাস ছাড়তে পারে না এবং ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয়। এই দুই রোগ একসাথে দেখা দিলে তাকে বলা হয় সিওপিডি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ। সিওপিডি রোগীরা সারাজীবন অক্সিজেনের অভাবে ভোগে এবং ধূমপান ছাড়া অন্য কোনো কারণ এত মারাত্মকভাবে এই রোগ সৃষ্টি করে না।
ধূমপানের আরেকটি ভয়াবহ প্রভাব হলো ফুসফুসের ক্যান্সার। সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে প্রায় ৭০টিরও বেশি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান রয়েছে। এগুলো ধীরে ধীরে ফুসফুসের কোষকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে বাধ্য করে। এক সময় কোষগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ক্যান্সারের রূপ নেয়। ফুসফুসের ক্যান্সার একবার হলে তা ছড়িয়ে পড়ে শরীরের অন্য অঙ্গেও। চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। বিশ্বের অধিকাংশ ফুসফুস ক্যান্সারের মূল কারণ ধূমপাশুধু তাই নয়, ধূমপান শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল করে। ফুসফুসে প্রাকৃতিকভাবে থাকা প্রতিরোধক কোষগুলো ধোঁয়ার প্রভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে ধূমপায়ী ব্যক্তিরা বারবার নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা কিংবা ভাইরাসজনিত শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। একটি সুস্থ ফুসফুস নিজে থেকেই জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, কিন্তু ধূমপানের কারণে সেই শক্তি নষ্ট হয়ে যায়।ধূমপান শুধু ধূমপায়ীর ফুসফুসকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং আশপাশের মানুষেরও ক্ষতি করে। পরোক্ষ ধূমপান বা প্যাসিভ স্মোকিংয়ের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা একই ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে। বিশেষ করে শিশুদের ফুসফুস অপরিপক্ব থাকে। তারা যদি নিয়মিত ধোঁয়ার মধ্যে শ্বাস নেয় তবে তাদের শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। গর্ভবতী নারীর আশেপাশে ধূমপান করলে গর্ভের শিশুর ফুসফুসেরও ক্ষতি হয় এবং জন্মের পর সে দুর্বল হয়ে আসে।
ধূমপানের কারণে ফুসফুস ধীরে ধীরে কালো হয়ে যায়। একটি সুস্থ ফুসফুসের রং গোলাপি হলেও দীর্ঘদিন ধূমপান করলে ফুসফুসের ভেতরে টার জমে গিয়ে তা কালো ও শক্ত হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ধূমপানকারী ব্যক্তির ফুসফুস কখনোই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না, এমনকি ধূমপান ছেড়ে দিলেও স্থায়ী ক্ষতি রয়ে যায়। তবে ধূমপান ছেড়ে দিলে নতুন ক্ষতির প্রবণতা কমে যায় এবং কিছুটা উন্নতি হয়।
ধূমপান ফুসফুসের জন্য ধীরে ধীরে মৃত্যুর ফাঁদ তৈরি করে। এটি শুধু ক্যান্সারই নয়, আরও অনেক জটিল রোগ ডেকে আনে। ফুসফুস আমাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটি, আর ধূমপান সেটিকেই ধ্বংস করে দেয়। তাই সুস্থ জীবন যাপন করতে চাইলে ধূমপান থেকে বিরত থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ধূমপান পরিহার করা শুধু নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্যও নিরাপদ সিদ্ধান্ত। কারণ সুস্থ ফুসফুস মানেই সুস্থ জীবন, আর ধূমপান মানেই জীবনের ধীরে ধীরে ক্ষয়ন।
Post a Comment